বিদেশে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের তালিকা চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি
কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ক্রয়কারী বাংলাদেশিদের তালিকা চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় দুদক থেকে গত ১১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ওই চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটির সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
দুদক মহাপরিচালক (মানিলন্ডারিং) আ ন ম আল ফিরোজের সই করা চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
• অর্থ পাচার রোধ না হলে দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা থেমে যাওয়ার শঙ্কা।
• ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
• অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে ৫০ দেশে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। দুদকের চিঠির সাড়া দিয়েছে ২২ দেশ।
• পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারস সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালছে।
• অর্থ পাচারকারীদের তথ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে চায় দুদক।
বিজ্ঞাপন
এর আগে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের তালিকা চেয়ে গত ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল দুদক।
সেকেন্ড হোম প্রকল্পের আওতায় বিদেশে বিনিয়োগ কিংবা বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্সসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে যেসব বাংলাদেশিদের নাম উঠে এসেছে তাদের বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ওই চিঠিতে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
‘বিভিন্ন দেশে পাচাকৃত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব থাকা বাংলাদেশিদের তালিকা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও পত্রিকায় প্রকাশিত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মিস-ইনভয়েসিং, হুন্ডি, ব্যাংক ক্যাশ ট্রান্সফার ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত তার মূলধন হারানোর ফলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য যে পরিমাণ দেশীয় বিনিয়োগ করা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হলে অর্থ পাচার রোধ করা একান্ত দরকার।’
চিঠিতে উদাহরণ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ এদেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগের (Investment Quota) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নাম উঠে এসেছে। এই ধারা রোধ করা সম্ভব না হলে আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ভবিষ্যতে থমকে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। অর্থ পাচারের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণ রোধের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। এতে একদিকে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে দেশীয় সম্পদ ফেরত আনার পাশাপাশি অন্যান্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ দুরূহ কাজ সম্পন্ন ও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব নয়।
চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আরও বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি দমন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের তথ্য কূটনৈতিক চ্যানেলে সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরবরাহ করলে কমিশন দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে পারবে। এ অবস্থায় ইনভেস্টমেন্ট কোটায় যেসব বাংলাদেশি নাগরিক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে তাদের সম্পর্কে তথ্য বা তালিকা আমাদের সকল দূতাবাসের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া যাবে কি না তা জানানোর জন্য কমিশনের নির্দেশক্রমে অনুরাধ করা হলো।’
বিভিন্ন ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াসহ ৫০টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-(এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুদক। যার মধ্যে ২২টি দেশ দুদকের পাঠানো চিঠির বিষয়ে সাড়া দিয়েছে।
এর আগে সম্প্রতি সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় আবাস গড়তে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করেছেন এমন ২৩ বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় দুদক। বিদেশে বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস জানতে ওই ভিআইপিদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে সংস্থাটি। চিহ্নিত ২৩ ব্যক্তির মধ্যে রাজনীতিবিদসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ‘পানামা পেপারস’ নামে নথি প্রকাশ করে। যেখানে ১ কোটি ১০ লাখ নথি ফাঁস করা হয়। ওই তালিকায় বিশ্বের কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানসহ শতাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রমাণ রয়েছে। যেখানে ৩৪ বাংলাদেশি ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের নাম আসে।
ওই বছরের ১৭ নভেম্বর বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলে বিদেশে বিনিয়োগ করার ২৫ হাজার নথি ফাঁস করে প্যারাডাইস পেপারস। যেখানে নতুন করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু, তার স্ত্রী নাসরিন ফাতেমা আউয়াল, ছেলে তাফসির আউয়াল ও তাবিথ আউয়ালসহ মোট ১০ জন বাংলাদেশির নাম আসে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ট্যাক্স ফাঁকি দিতে মাল্টায় বিভিন্ন কোম্পানিতে অর্থ বিনিয়োগ করার নতুন তালিকা প্রকাশ পায়। প্রকাশিত এ তালিকায় রয়েছে আরও ২০ জন বাংলাদেশির নাম।
পানামা পেপারস সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে দুদকের উপপরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঁঞার নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিম কাজ করছে। আর প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দুদক পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর তত্ত্বাবধানে ওই টিম অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
আরএম/এইচকে