প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি যেদিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ নিয়েছিলাম সেদিনই বলেছিলাম দেশের সেবক হিসেবে কাজ করবো। প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার কাছে আর কিছু না কেবল কাজের সুযোগ, কাজের ক্ষমতাটার প্রাপ্তি। মানুষের জন্য কাজ করবো, মানুষের সেবা করবো। আমার সরকার মানে মানুষের সেবক। সেই সেবক হিসেবেই কাজ করতে চাই।’

বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের (এসএসএন) বিভিন্ন ভাতা সরাসরি উপকারভোগীদের মোবাইল ফোনে পাঠানোর উদ্যোগের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ সময় সমাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব থেকে বেশি উপকারভোগী জেলাসমূহের মধ্যে চাঁদপুর, পিরোজপুর, লালমনিরহাট ও নেত্রকোণা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতার টাকা এখন থেকে সরাসরি উপকারভোগীর মোবাইলে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যে ভাতাটা যাকে দিচ্ছি, সেটা যেন সরাসরি সেই মানুষটার হাতে পৌঁছায়। মাঝে যেন আর কেউ না থাকে। অর্থাৎ টাকাটা যাদের প্রয়োজন তারাই পাচ্ছেন এবং তাদের যেভাবে খুশি তারা ব্যবহার করতে পারবেন।’

আমরা যখন বয়স্ক ভাতা চালু করেছিলাম তখন এভাবে চিন্তা করেছিলাম- কেউ কেবল ভাতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ুক সেটা আমরা চাইনি। ভাতা পাবে কিন্তু যাদের কর্মক্ষমতা রয়েছে তারা কিছু কাজও করবেন। একেবারে ঘরে বসে থাকবেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা প্রত্যেকটি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে সারাদেশের জেলার সংখ্যা ২৯ থেকে বাড়িয়ে ৬০টি করেন। যেটি বর্তমানে ৬৪টি হয়েছে। এখন থেকে দু’টি শীর্ষ মোবাইল ফাইনান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ ও ‘বিকাশ’ এর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বয়স্ক ভাতা, বিধাবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা সরাসরি উপকাভোগীদের মোবাইল ফোনে পাঠানো হবে। এটা করার জন্য তার সরকার দীর্ঘদিন থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি এ ব্যবস্থা চালুর জন্য সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

পল্লী অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে জাতির পিতাই প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তিনি পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম, প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত হাসপাতাল করা থেকে শুরু করে সমবায় ভিত্তিক চাষাবাষ চালু এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে সে সময়ে অন্তত ১০ কেজি চাল ক্রয়ের সামর্থ অর্জনে ১শ টাকা করে ভাতার প্রচলন করা হয়। যা বর্তমানে ৫শ টাকা হয়েছে এবং ভাতাপ্রাপ্ত জনগণের সংখ্যাও অনেক বাড়ানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্যটা হচ্ছে দেশের কোনো মানুষ যেন নিজেকে অপাংক্তেয় মনে না করে এবং এর মাধ্যমে প্রত্যেকের প্রতি রাষ্ট্রের যে কর্তব্য রয়েছে সেটাই আমরা করতে চাই।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতে রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভনিং’ এর- ‘দ্যা উডস আর লাভলি ডার্ক অ্যান্ড ডিপ/বাট আই হ্যাভ প্রমিজেস টু কিপ/ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ/’ কবিতাটির উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। এসময় তিনি বলেন, আমার ক্লান্ত হওয়া চলবে না, ঘুমালে চলবে না, মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে- আর সেই লক্ষ্যটা হচ্ছে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের জীবনটাকে যিনি উৎসর্গ করেছিলেন এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোটা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ, তারপরেও সে কাজই জাতির পিতা করতে চেয়েছিলেন। জীবনের সবরকম সুখ-স্বাচ্ছন্দকে তিনি দেখেননি। বার বার আঘাত এসেছে, মৃত্যুকে কাছ থেকেও দেখেছেন কিন্তু লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ফাঁসির আদেশ, গুলি, বোমা, কিছ্ইু তাকে টলাতে পারেনি। দেশকে এভাবে ভালোবাসার শিক্ষাটা তিনি পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। কারণ, তাদের পরিবার নয়, দেশের মানুষই জাতির পিতার কাছে সব থেকে বড় ছিল। 

‘এই ঘুণে ধরা সমাজটাকে আমাদের পরিবর্তন করতে হবে’-জাতির পিতার ভাষণের এ উদ্ধৃতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গোটা বাংলাদেশটাকে তিনি ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। যা কেবল রাজধানী বা শহর কেন্দ্রিক ছিল না, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।’ ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর মানুষের দুর্দশার যে চিত্র তিনি দেখেছিলেন তা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, মানুষের পেটে খাবার ছিল না, বিদেশ থেকে পুরনো কাপড় এনে মানুষকে পড়তে দেওয়া হতো, তাও অনেকে পেতনা। দিনের পর দিন দুর্ভিক্ষ চলেছে, মানুষের সারি দেখে মনে হতো যেন জীবন্ত কঙ্কাল- এ ধরনের একটা পরিবেশ আমার নিজের চোখেই দেখা।

প্রধানমন্ত্রী সে সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্মৃতিচারণ করে বলেন, তখন থেকেই এ চিন্তাটা ছিল, কি করবো- ক্ষমতায় গেলে? কাজেই ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় গিয়েই দেশের বয়োবৃদ্ধ, স্বামী পরিত্যক্তা এবং পরে প্রতিবন্ধী এবং সে সময়ে সব থেকে অবহেলায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করি, বলেন তিনি।

জাতির পিতা প্রদত্ত সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের (ঘ) উদ্ধৃতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নতুনভাবে কোনকিছু চিন্তা করতে হয়নি, জাতির পিতা সংবিধানেই সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিধান দিয়ে গেছেন। যে পদাঙ্ক অনুসরণ করেই ১৯৯৭ সাল থেকে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে ঠিকানা দিতে তার সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্পের শুরু।

অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচির ওপর একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।

এসময় জানানো হয়, ইতোমধ্যে ভাতাভোগীদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় মোট ৮৮ লাখ ৫০ হাজার বিভিন্ন ভাতাভোগী-শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৬৯ লাখ জনের তথ্য জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যেই সব ভাতাভোগীকে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ভাতা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

টিআই/এসএম