সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের বিভিন্ন সার্কেল অফিসে প্রয়োজনীয় জনবল থাকার পরও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমএলএস পদে কর্মরত ব্যক্তিদের কাউকে গাড়িচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আবার কাউকে অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পদায়ন করা হয়েছে। 

এসব অপকর্মের হোতা সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের কারখানা সার্কেলের সদ্য বদলি হওয়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদ। 

অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের পর সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা নিয়োগ বাতিলের জন্য চাপ দিলেও তা পাত্তা পায়নি এই কর্মকর্তার কাছে। এসবের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন দফতরে গায়ের জোরেই নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগের কোনোটিই সত্য নয় বলে দাবি তার। 

মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত ১৯ আগস্ট ওই দফতর থেকে তাকে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে সওজ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের সরঞ্জাম ও সংরক্ষণ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তিনি।

মোসলেহউদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে ২০১৯ সালে। তবে দুদকের বাছাই কমিটি থেকে অভিযোগটি গায়েব হয়ে যায়। এরপর থেকেই নতুন উদ্যমে তার দুর্নীতির রথ চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, মোসলেহউদ্দিন অধিদফতরের বিভিন্ন সার্কেলে কর্মরত থাকা অবস্থায় কমপক্ষে ৫০ ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে বিভাগীয় অফিসের চাহিদা ছাড়াই নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। অধিদফতরের কারখানা সার্কেল শাখায় চাকরিকালীন প্রায় ১৬ ব্যক্তিকে এম আর কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

গত ১৯ আগস্ট কারখানা সার্কেল থেকে বদলির আগে তিন জন কর্মচারী নিয়োগ দেন মোসলেহউদ্দিন। এছাড়া নিয়োগ দেওয়া কর্মচারীদের বাসার কাজেও নিযুক্ত করেছেন তিনি। মাস্টার রোলে নিয়োগ দিয়ে মো. সুমন ও জসীমকে গত প্রায় দুই বছর ধরে মোসলেহউদ্দিন তার বাসার কাজে নিযুক্ত রেখেছেন। তাদের প্রত্যেকের বেতন মাসে ১৫ হাজার টাকা। ফেরি প্ল্যানিং সার্কেল থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বদলি করে শুধু নিজের বাসার কাজকর্ম করানোর জন্য তাদের নিয়ে আসেন এই মোসলেহউদ্দিন। 

জনবল থাকার পরও অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়ে সরকারি অর্থের অপচয়ও করেছেন মোসলেহউদ্দিন। তার একটি উদাহরণ ওয়েন্ডার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ওয়াসী উল্লাহ সজীব।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১১ আগস্ট সওজ অধিদফতরের ময়মনসিংহ সার্কেলে ওয়েন্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ওয়াসী উল্লাহ সজীবকে। সজীবের বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের সাভিনগর গ্রামে। এই ব্যক্তির নিয়োগের পর ময়মনসিংহ সার্কেলের কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমান মোসলেহউদ্দিন আহমেদের কাছে একটি চিঠিতে জানান, বর্তমানে ময়মনসিংহ কারখানা সার্কেলে দুটো ওয়েন্ডার পদের মধ্যে দুটোতেই জনবল রয়েছে। ফলে এই পদে আর কোনো জনবলের প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে এই দফতরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাস্টাররোলের কর্মচারী (এমআর) রয়েছে। অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে প্রতি মাসে হাজিরা ভিত্তিতে বেতন দেওয়াও দুরূহ হয়ে পড়েছে বলেও তিনি জানান। চিঠিটি ১২ আগস্ট পাঠানো হয়।

অতিরিক্ত জনবল থাকার পরও ঢাকার তেজগাঁওয়ে কারখানা বিভাগে দুই জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হলে সেখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী গুঞ্জন বড়ুয়া সংক্ষুদ্ধ হয়ে চিঠি লেখেন মোসলেহউদ্দিনকে। ২৫ আগস্ট গুঞ্জন বড়ুয়া চিঠিতে লেখেন, ‘অত্র দপ্তর হতে কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগের কোনো চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও দুই জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এ দফতরে সর্বমোট ৪৭ জন কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে কর্মরত আছে। যাদের বেতন প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না।’

এ ব্যাপারে গুঞ্জন বড়ুয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতিরিক্ত শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়েছেন সওজ প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোসলেহউদ্দিন আহম্মদ। তিনি গত ১৯ আগস্ট ওই দফতর থেকে বদলি হন।  

কারখানা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় গত ১১ আগস্ট মোসলেহউদ্দিন কারখানা উপবিভাগের সহকারি স্টোর কিপার পদে সিরাজগঞ্জ সদরের মিরপুর বিড়ালাকুঠি গ্রামের আল আমিনকে ও জরুরি গাড়ির এসি মেরামত কাজের জন্য কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার সাভিয়া নগরের সোহান মিয়াকে প্রধান কার্যালয়ের কারখানা উপবিভাগের সহকারি মেকানিক হিসেবে নিয়োগের জন্য দপ্তরাদেশ দেন। কাজ নেই মজুরি নেই ভিত্তিতে তাদের তিন মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়ার আদেশ দেন তিনি। 

অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগের পেছনে ছিল ঘুষ বাণিজ্য। এসব নিয়োগের ফলে বেতন-ভাতা বাবদ অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়েছে সরকারের। নিয়োগ পাওয়াদের মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। এ হিসেবে সরকারের প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা অপচয় করেন তিনি।

সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রণ ও সংগ্রহ সার্কেল থেকে কারখানা সার্কেল, ঢাকায় বদলি হওয়ার আগমুহূর্তেও তিনজনকে নিয়োগ দেন। এখানে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ দুদকে 
মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে দুদকে অভিযোগ করা হয় ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর। তাতে বলা হয়, মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদ একজন ক্ষমতাবান কর্মকর্তা। কমিশন ও নিজস্ব পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া তিনি কোনো কাজ প্রদান করেন না। তিনি আরও কিছু দুর্নীতি পরায়ন নির্বাহী প্রকৌশলী ও অফিস কর্মকর্তা দ্বারা নিজস্ব একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে তার  আলীশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। দুই সন্তানকে কানাডায় ও যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করাচ্ছেন। স্ত্রী ও সন্তানদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ও ব্যাংক ব্যালেন্স। মোসলেহউদ্দিন আহাম্মদের ভয়ে আমরা আমাদের নাম ও পরিচয় গোপন রাখছি। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করলে তার দুর্নীতি বের হয়ে আসবে। সেই সঙ্গে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। 

মোসলেহউদ্দিন বলছেন অভিযোগ সত্য নয় 
মোসলেহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমি অনিয়ম ও দুর্নীতি করিনি। একটি দুষ্ট চক্র আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ‘মজুরি নেই, কাজ নেই’ ভিত্তিতে আমি প্রয়োজনেই নিয়োগ দিয়েছি শ্রমিক-কর্মচারীদের।

কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান অভিযোগ করেছেন যে জনবল অতিরিক্ত থাকার পরও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কেন নিয়োগ দিলেন এ প্রশ্নের জবাবে মোসলেহউদ্দিন বলেন, এই অভিযোগ আমি জানি না। সময় মতো আমি জানতে পারিনি। ওই চিঠি ব্যাগ ডেটে (তারিখ পিছিয়ে দেখানো হয়েছে) করা হয়েছে। আমার কাছে আরিফুর রহমানের অভিযোগ আসেনি। আমি প্রমাণ করে দিতে পারবো তার চিঠি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আরিফুর রহমান বলেছেন, অতিরিক্ত জনবল নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তার সঙ্গে আলাপ করার পর চাহিদা জেনেই নিয়োগের আদেশ দিয়েছি। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগ সত্য নয়। আমি সরকারের আইন মেনে কাজ করেছি।  

পিএসডি/এনএফ