ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন নাহিদা রুনাই। কাগজে কলমে এমন পরিচয় থাকলেও মূলত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবেই তাকে চেনে সবাই। গত ১৬ মার্চ গ্রেফতার হন তিনি। 

চট্টগ্রামের খুলশীর মেয়ে নাহিদা রুনাই। বাবা সামান্য কেরানী হলেও পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ার কল্যাণে প্রায় শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানে তার ব্যাংক হিসাবে ৭২ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে।

পি কে হালদারের নানা অর্থিক অনিয়মের অন্যতম সুবিধাভোগী ছিলেন নাহিদা। দুদকের কাছে দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তিনি নিজেই তা স্বীকার করেছেন। 

জবানবন্দিতে নাহিদা জানান, কমিশন হিসেবে পি কে সিন্ডিকেটের সদস্য ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঋণ গ্রহীতা স্বপন কুমার মিস্ত্রির কাছ থেকে নাহিদা রুনাই ১৫ কোটি টাকা নিয়েছিলেন, যা দিয়ে তিনি শেয়ার ব্যবসায় নেমেছিলেন।

শুধু তাই নয়, জবানবন্দিতে নাহিদা রুনাই বর্ণনা দেন, কীভাবে তিনি পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তিনি জানান, পি কে হালদারের নিদের্শেই অস্তিত্বহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মর্টগেজ ছাড়া ব্যাংকিং রীতি-নীতির বাইরে ঋণ দেওয়া হয়।  

তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের কাছে বৃহস্পতিবার দেওয়া জবানবন্দি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে নাহিদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা স্বীকার করলেও বিস্তারিত জানতে দুদকের জনসংযোগ দফতরে যোগাযোগ করতে বলেন। অন্যদিকে জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপপরিচালক) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।

যেভাবে পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ হন নাহিদা রুনাই

নাহিদা রুনাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, তিনি ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (আইআইডিএফসি) অফিসার হিসেবে চট্রগ্রাম শাখায় যোগ দেন। তখন আইআইএফডিসির এমডি ছিলেন আসাদুজ্জামান খান এবং ডিএমডি ছিলেন পি কে হালদার। সেখানে ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে অ্যাসিটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন তিনি। তখন তার সরাসরি রিপোর্টিং বস ছিলেন পি কে হালদার। তিনি তখন লোন ডিভিশনে ছিলেন। এরপরই তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হন।  

জবানবন্দিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ২০১১ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এসভিপি ছিলেন মো. রাশেদুল হক। ২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরের জুলাই মাসে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের এমডি মো. রাসেল শাহরিয়ার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি পি কে হালদারের রুমে আসেন। তখন পি কে হালদার নাহিদা রুনাইকে এফএএস ফাইন্যান্স লিমিটেডে যোগ দিতে বলেন। তার যোগ দেওয়ার ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর পি কে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং-এ রাশেদুল হকের অধীনে চাকরি করতে বলেন।

নাহিদা রুনাই শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বিজনেস হেড হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬ সালের ফ্রেবুয়ারি পর্যন্ত বিজনেস হেড হিসেবে চাকরি করে অফিসিয়াল ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করেন। এইচআর বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির পর। সে সময় তিনি শেয়ার ডিভিশনও দেখভাল করতেন।

পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ার কারণে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঋণ গ্রহীতা স্বপন কুমার মিস্ত্রির কাছ থেকে ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন নাহিদা। স্বপণ কুমার মিস্ত্রির আরেক পরিচয় হলো, তিনি পিকে হালদারের ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী সুকুমার মৃধার ভাগিনা।

বিদেশ ভ্রমণ

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র বান্ধবী হওয়ার সুবাদে পি কে হালদারের সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ বার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন নাহিদা রুনাই। এবার দুদকে দেওয়া তার নিজের জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে তেমনই তথ্য।
 
বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে নাহিদা রুনাই জানান, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে যোগ দেওয়ার পর কক্সবাজারের রেডিসন ব্লু হোটেলে বিভিন্ন অফিসিয়াল মিটিংয়ে অংশ নেন। তিনি ছয় থেকে সাত বার মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. জাহাঙ্গীর আলম ও প্রশান্ত কুমার হালদারদের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মালেয়শিয়া ও ব্যাংকক ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাছাড়া, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজে আরও চার থেকে পাঁচ বার দেশের বাইরে যান তিনি। ভারতে কেনাকাটার জন্য গেছেন ১০ থেকে ১২ বার।
 

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ

জবানবন্দি সূত্রে জানা যায়, পি কে হালদারের নিদের্শেই মূলত বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের ভিজিট প্রতিবেদন ছাড়াই এবং অনেক ক্ষেত্রে কোনো মর্টগেজ না নিয়ে ব্যাংকিং রীতিনীতির বাইরে গিয়ে নাহিদা রুনাই, এমডি রাশেদুল হক, এভিপি আল মামুন সোহাগ, সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী ঋণ প্রপোজাল তৈরির পর ইন্টারন্যাল মেমোতে স্বাক্ষর দিয়েছেন। বোর্ডে অনুমোদন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণের অর্থ না পাঠিয়ে পি কে হালদারের মৌখিক নিদের্শে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠানো হতো। 

পি কে হালদারের নিদের্শে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এন্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সাবেক এমডি রাশেদুল হক, ম্যানেজার অভীক সিনহা লিপরো ইস্টারন্যাশনাল নামীয় অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ১৬টি চেকের মাধ্যমে ১১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৭টাকা দেন, যা প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে পাঠানো হয়।

দুদক উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত দল পি কে হালদারসহ সংশ্লিষ্টদের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। ওই দল ইতোমধ্যে ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলায়  এক হাজার ১০০ কোটি টাকা দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। বিপদ অনুমান করতে পেরে দেশ থেকে পালিয়ে যান পিকে হালদার। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করে ইন্টারপোল।

আরএম/আরএইচ/জেএস