এস-ফ্যাক্টর (S-factor), সর্বরোগের মহৌষধ! ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা হার্টের ওষুধই নয়, করোনা প্রতিরোধেও কার্যকর— এমন প্রচারণা চালিয়ে পার্সেন্টেজ ও প্যাকেজের ফাঁদে ফেলে লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে ২৫ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ‘সুইসডার্ম’ নামের ভুঁইফোড় এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

পাঁচ ক্যাটাগরিতে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতো সুইসডার্ম। একেক ক্যাটাগরির জন্য একেক ধরনের প্যাকেজ। চার হাজার ২০০ টাকার প্যাকেজ থেকে শুরু করে এক লাখ ১৭ হাজার টাকার প্যাকেজ। প্যাকেজের বিপরীতে থাকত এক থেকে ২৮ প্যাকেট নকল ওষুধ। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনকারী ভুয়া প্রসাধনী সামগ্রীও উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতো তারা। প্রতিষ্ঠানটির ছিল না নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা বা সাইনবোর্ড।

র‌্যাব জানায়, সুইসডার্ম প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রমই প্রতারণামূলক। তাদের পণ্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কিংবা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছিল না। তাদের ছিল না বৈধ কোনো কাগজপত্র

সুনির্দিষ্ট এসব অভিযোগের ভিত্তিতে ‘সুইসডার্ম’ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কাজী আল-আমিনসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তাদের গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। র‌্যাব জানায়, সুইসডার্ম প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রমই প্রতারণামূলক। তাদের পণ্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) কিংবা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছিল না। তাদের ছিল না বৈধ কোনো কাগজপত্র। সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিত না প্রতিষ্ঠানটি। শুধুমাত্র পার্সেন্টেজ আর প্যাকেজে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে লক্ষাধিক গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

‘সুইসডার্ম’ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কাজী আল-আমিনসহ গ্রেফতার ১৭ জন

এ বিষয়ে র‍্যাব-৪ এর (হেডকোয়ার্টার কোম্পানি) উপ-পরিচালক ও পুলিশ সুপার জয়িতা শিল্পী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ও ই-কমার্স ব্যবসার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়েছে। দেশজুড়ে সমালোচিত হচ্ছে ই-কমার্স ব্যবসা। এমন সময়ে সুইসডার্ম নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রতারণামূলক নানা তথ্য আমাদের কাছে আসে।

তিনি বলেন, প্রথমে আমাদের কাছে দুই ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্তে সত্যতা পাবার পর গতকাল মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে আজ (বুধবার) সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি চৌকস দল রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান চালায়। সুইসডার্ম প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পরিচালক কাজী আল আমিনসহ (৩৪) ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

চক্রটির মূলহোতা কাজী আল আমিন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটির নতুন সদস্যদের কাছে প্রবাসী কিংবা বিভিন্ন দফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রলুব্ধ করতো। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিত

বাকিরা হলেন- মো. সালাউদ্দিন (৪৬), শেখ মো. আব্দুল্লাহ (৫৯), মনিরা ইয়াসমিন (৪৩), জাহিদ হাসান (৪২), মো. স্বপন মিয়া (৩৮), শাহজাহান (২৫), মিজানুর রহমান (৫০), বাদশা ওরফে সুলাইমান (২৬), ইমাম হোসাইন (৩৫), আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আনারুল ইসলাম (৪২), মিজানুর রহমান (৩৯), ফারুক উদ্দিন (৪৭), আঞ্জুমান আরা বেগম (৫২), শেখ রবিন (৩৩), ইমাম হোসাইন (৩৫) ও আছমা বেগম (৩৫)।

অভিযানে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত দুটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টর, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবহৃত দুটি সিল, ব্যানার, হিসাবের ডায়েরি ও খাতা, রেজিস্টার, প্রতিষ্ঠানটির ১২৫টি লিফলেট, প্রতারণায় ব্যবহৃত সুইসডার্মের ভুয়া ওষুধ ও প্রসাধনী সামগ্রী, ২৫ সেট ডিসট্রিবিউটর ওয়ার্কিং ফাইল, ২৩টি মোবাইল ফোন এবং নগদ এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৫ টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাবের অভিযানে সুইসডার্মের প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম 

সুইসডার্মের প্রথম টার্গেট সদস্য সংগ্রহ করা

চক্রটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী বা সদস্য রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বেকার ও অসচ্ছল যুবক-যুবতী এমনকি শিক্ষিত লোকজনকে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার ও সাধারণ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। নিয়মিত যাতায়াত ও কথাবার্তায় পটু, আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল— এমন লোকদের সদস্য সংগ্রহের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য করা হয় এবং নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

ভুয়া পদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা

চক্রটির মূলহোতা কাজী আল আমিন দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটির নতুন সদস্যদের কাছে প্রবাসী কিংবা বিভিন্ন দফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রলুব্ধ করতো। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিত। ভুক্তভোগীদের প্রলুব্ধ করে, ভুলিয়ে অথবা নানা কৌশলে প্রতারক চক্রের অফিসে আনার ব্যবস্থা করতো। তাদের মাধ্যমে নতুন নতুন গ্রাহক বা টার্গেট সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা (Percentage) দেওয়ার প্রলোভন দিত।

সুইসডার্ম প্রতিষ্ঠানটি মধ্যশিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবক এবং শিক্ষিত সরল শ্রেণির লোকজনদের মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সদস্য পদ দিত। এরপর সুইসডার্ম অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়

প্রতারণার কৌশল

সুইসডার্ম সভা-সেমিনার, মোটিভেশনাল ওয়ার্কশপ বা আকর্ষণীয় লাঞ্চ ও বুফে ডিনার পার্টির আয়োজন করতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এসব পার্টির আয়োজন করা হতো। অসহায়, নিরীহ ও অর্ধশিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত ভিকটিমরা এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন দেখে প্রতারণার ফাঁদে পা দিত।

সুইসডার্মের প্রতারক চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা অর্থ

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সুপার জয়িতা শিল্পী বলেন, সুইসডার্ম প্রতিষ্ঠানটি মধ্যশিক্ষিত বেকার ও নিরীহ যুবক এবং শিক্ষিত সরল শ্রেণির লোকজনদের মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান ও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সদস্য পদ দিত। এরপর সুইসডার্ম অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে প্রতারণা করে লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবে তাদের গ্রাহকের সংখ্যা রাজধানীসহ সারাদেশে দুই লাখ ছাড়িয়ে যায়। প্রতারণার কৌশল হিসেবে তারা ঘন ঘন অফিস পরিবর্তন করতো।

এস-ফ্যাক্টরকে সর্বরোগের ওষুধ বলে ব্যাপক প্রচারণা

সুইসডার্মের ব্যানারে এস-ফ্যাক্টর ওষুধটি ‘সর্বরোগের মহৌষধ’ বলে প্রচারণা চালানো হয়। যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও হার্টের ওষুধ; এমনকি করোনা প্রটেক্টিভ হিসেবেও কাজ করে বলে প্রচার চালায় প্রতারক চক্রটি।

৫ ধাপে সদস্য পদ, ধাপে ধাপেই প্রতারণা

নতুন সদস্যদের পাঁচ ক্যাটাগরির মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করতো সুইসডার্ম। প্রথম ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে চার হাজার ২০০ টাকা থেকে ছয় হাজার ২০০ টাকার বিনিময়ে এক প্যাকেট ওষুধ, তৃতীয় ও চতুর্থ ক্যাটাগরিতে ২৬ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৫৮ হাজার টাকার ছয় থেকে ১৪ প্যাকেট ওষুধ দেওয়া হতো। পঞ্চম ক্যাটাগরিতে এক লাখ ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ২৮ প্যাকেট ওষুধ দেওয়া হতো। যার সবই ভুয়া। এসব ওষুধের মধ্যে এস-ফ্যাক্টরও ছিল।

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জয়িতা শিল্পী বলেন, প্রতিষ্ঠানটির নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা বা সাইন বোর্ড ছিল না। বিএসটিআই বা ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছিল না। ছিল না পণ্য আমদানি সংক্রান্ত বৈধ কোনো কাগজপত্র বা ডিক্লারেশন। সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্সও দিত না তারা।

‘এক কথায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার প্রলোভন এবং গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক পার্সেন্টেজ পাওয়ার প্রলোভনে নিরীহ, অসহায় ও সরল ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলা হতো। এস-ফ্যাক্টর ওষুধকে সর্বরোগের মহৌষধ হিসেবে বিক্রির পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিভিন্ন ভুয়া প্রসাধনী সামগ্রীও উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে আসছিল তারা’— বলেন এ র‍্যাব কর্মকর্তা।

জেইউ/এমএআর/