‘ঢাকার কেরানীগঞ্জে আমার একটি স্যানিটারি পণ্যের দোকান ছিল। করোনার কারণে গত দেড় বছর আগে আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জীবন-জীবিকা নিয়ে সমস্যায় পড়ে যাই। গত দুই মাস আগে মোটরসাইকেলটি নিয়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রী বহন করি। এই রাইড শেয়ারিং দিয়ে যা টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চলে,’ বলছিলেন রাজধানীতে নিজের মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে ফেলা শওকত আলী।

‘কিন্তু রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো প্রতি রাইডে ২৫ ভাগ টাকা কেটে নেয়। যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটুকু শুধুমাত্র করে অ্যাপগুলো। এজন্য তারা এই টাকা কেটে নেয়। অ্যাপে চালালে মামলা দেয় না পুলিশ, কিন্তু অ্যাপে না চালিয়ে যাত্রী বহন করলে মামলা খেতে হয়। অ্যাপের জন্য কেন আমি মামলা খাব? আমি কি রাস্তায় চুরি করতে নেমেছি? এই ক্ষোভ থেকে মোটরসাইকেলটি পুড়িয়ে ফেলি।’

সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয় থেকে বের হয়ে নিজের বাসায় গিয়ে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার চালক শওকত আলী যে কারণে মোটরসাইকেলটি পুড়িয়েছেন তার বিস্তারিত জানান।

এর আগে, সোমবার সকালে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডে এলাকায় নিজের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন শওকত আলী। তার মোটরসাইকেল পুড়ানোর ভিডিও দেশে আলোচিত-সমালোচিত হয়। পরে তার পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলসহ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাড্ডা থানায়। সেখান থেকে শওকত আলীকে দুপুরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিসি গুলশানের অফিসে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে থেকে রাত ৯টায় ডিসি গুলশানের অফিসে থেকে বের হয় রাত ১১টায় বাসায় যান শওকত আলী।

বাসায় পৌঁছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শওকত আলী বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হই। যাত্রী নিয়ে গুলশান যাই। সেখান থেকে লিংক রোডে যাই আরেকজন যাত্রী তোলার জন্য। যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করার সময় আনুমানিক সাড়ে ৯টায় একজন ট্রাফিক পুলিশ এসে মোটরসাইকেলের কাগজ চান। পরে ট্রাফিক পুলিশকে গত দুই সপ্তাহে আগে মামলা খাওয়ার বিষয়টি জানান।’

‘ওই পুলিশ কর্মকর্তা যখন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছিলেন এরই মধ্যে আমি রাইড শেয়ারিং অ্যাপের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেই। তবে আজকের ঘটনাটি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ঘটনা। এখানে পুলিশের কোনো দোষ নেই।’

অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার বিরুদ্ধে তার কী অভিযোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংসার চালাতে ও পেটের দায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামি। কিন্তু রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কারণে রাস্তায় প্রায় সময় মামলা খেতে হয়। দুই সপ্তাহে আগেও মামলা খেয়েছি। সারা দিন রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে যাত্রী আনা-নেওয়া করি। আর যাত্রীদের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ করিয়ে অ্যাপগুলো নেয় ২৫ ভাগ টাকা। অ্যাপে চললে মামলা খাব না, না চললে খাব এ কেমন অন্যায়। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘রাইড শেয়ার করছি পেটের দায়ে। চুরি করার জন্য রাস্তায় বের হইনি। আপডেট কাগজ থাকার পরেও আমি বাইক নিয়ে রাস্তায় বের হলে কেন মামলা খাব? আমি কোনো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার পক্ষে নই। অ্যাপস দিয়ে আমার লাভটা কোথায়? অ্যাপসে শুধু একটাই লাভ যাত্রীদের সঙ্গে কন্টাক্ট করিয়ে দেবে। অ্যাপসে হয়রানি প্রচুর। অ্যাপসে একটি ট্রিপ মারলে তেমন লাভ হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে আমি যে কাজটি করেছি তা খুবই অন্যায়। আমার বিরুদ্ধে মামলাও হতে পারত। গাড়ি পুড়িয়ে আমার প্রতিবাদটি ছিল শুধুই রাইড শেয়ারিং অ্যাপস কোম্পানির বিরুদ্ধে। তবে এটি করা আমার উচিত হয়নি। বিষয়টি আমি পরে বুঝতে পেরেছি। দোষ করলে পুলিশ মামলা দেবে এটিই স্বাভাবিক।’

প্রায় ১২ ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে থাকার প্রসঙ্গে শওকত আলী বলেন, ‘বাইকে আগুন দেওয়ার সকালে থানায় গিয়েছিলাম। এরপর সেখান থেকে আমার ইচ্ছা ছিল গুলশানের ডিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। থানা থেকে বের হয়ে গুলশানের ডিসি স্যারের অফিসে যাই। সেখানে রাতে ডিসি স্যারের সঙ্গে দেখা হয় এবং কথা হয়। এরপর রাতে বাসায় ফিরি।’

এ বিষয়ে সোমবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘বাড্ডায় মোটরসাইকেলের কাগজপত্র ঠিক আছে কি-না দেখতে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট এক ব্যক্তিকে থামায়। তখন ওই মোটরসাইকেল চালক কাগজপত্র না দিয়ে এক ধরনের ক্ষিপ্ত আচরণ করেন। পরে তিনি নিজেই নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। প্রাথমিকভাবে তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। তবে এ ঘটনায় কর্তব্যরত সার্জেন্টের কোনো দোষ আছে কি-না বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’

গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেখানে আগে থেকেই ট্রাফিক সদস্যদের বলা ছিল সকালে যেন সেখানে কোনো মোটরসাইকেল না দাঁড়ায়। ঘটনাস্থলে রাইড শেয়ারিংয়ের একটি মোটরসাইকেল দাঁড়ালে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা চালকের কাছে কাগজপত্র দেখতে চান। কিন্তু ওই চালক কাগজপত্র না দেখিয়ে উল্টো রেগে গিয়ে নিজের বাইকে আগুন ধরিয়ে দেন।’

এমএসি/ওএফ