ফাইল ছবি

প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকা থাকা সত্ত্বেও চালের বাজার অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে কাজ করছে ‘অদৃশ্য হাত’। মূলত বড় চালকল মালিক, ব্যবসায়ীরাই দেশের চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন। আবার সরকারের তথ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, মজুদ পরিস্থিতির নাজুকতা, বাজার পর্যবেক্ষণের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফলনে ভাটা, সঠিক সময়ে আমদানির সিদ্ধান্তে যেতে না পারার সুযোগকেও কাজে লাগাচ্ছে এ ‘অদৃশ্য হাত’।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে এক গবেষণা জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষণা দল ৯টি কারণ উদঘাটন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম বড় কারণ হলো ‘অদৃশ্য হাত’ এর কারসাজি।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের আব্দুর রউফ সরকার, ড. মো. আব্দুস ছালাম ও ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও কৃষক, ব্যবসায়ী, চালকল মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে এ গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করা হয়।

গবেষণা কার্যক্রমটির সঙ্গে কাজ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি বিপণন অধিদফতর, ট্যারিফ কমিশন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। পুরো গবেষণা কার্যক্রমটি সমন্বয় করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।

গবেষণা চালের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার মোট নয় কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মিলার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা; তথ্য বিভ্রাট, সরকার যে তথ্য দেয় তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল না পাওয়া; সরকারি সিদ্ধান্ত, সঠিক সময়ে আমদানির সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নে ধীর গতি; মহামারীতে সাধারণ মানুষের মজুদ প্রবণতা বেড়ে যাওয়া; ধানের আবাদে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি; মৌসুমি ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম; প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদনে কিছুটা ভাটা; চাল ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের মধ্যে গ্রুপিং ও রাজনৈতিক ছত্রছায়া; মুক্ত বাজার অর্থনীতির কারণে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে নাই, ফলে যে যার মতো করে ব্যবসা করার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

গবেষণা দেখা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সরকার কোনো বছরই খাদ্য মজুদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এ সুযোগ নিয়েছে ওই বড় বড় ব্যবসায়ীরা (‘অদৃশ্য হাত’)। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে ধানও কিনছে একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। তারাই মূলত ঠিক করে দেয় যে, ধান চালের বাজারদর কী হবে, কত হবে?

গবেষণায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, সরকারকে অবশ্যই সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টনের নিচে চাল মজুদ রাখা যাবে না। আর বার্ষিক মজুদ ২৫ লাখ মেট্রিক টন নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে থাকতে হবে সরকারকেই। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া যে নয়টি কারণ উদঘাটন হয়েছে সেগুলো সমাধান করতে হবে।

ব্রি সূত্র জানায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানে মোটা চালের দাম কোনোভাবেই কেজিপ্রতি ৪০ টাকার উপরে হওয়া উচিত নয়, কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে চাল কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষদের। ২০২১ জুনে চাহিদা পূরণ করেও ৩০ লাখ মেট্রিক টন বেশি থাকবে।

গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য ব্রির কৃষি অর্থনীতি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুর রউফ সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু দরকার হবে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত। উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে যান্ত্রিকীরণসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রণোদনার অর্থ সঠিকভাবে বণ্টনও জরুরি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। এ অবস্থায় তৃণমূলসহ মধ্যম আয়ের মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। দ্রুত এর সমাধান চান তারা।

একে/এমএইচএস