বাংলাদেশ বেতারে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামসহ উন্নয়ন প্রকল্পের কেনাকাটায় লুটপাটের হোতাদের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের যন্ত্রপাতি ও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কেনাকাটা কিংবা মেরামতের নামে অর্ধকোটি টাকা লোপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ ও ময়মনসিংহে দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ১০ কিলোওয়াট এফএম বেতারকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতি ও লুটপাটের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যেখানে কোনাে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই আরও প্রায় ৩১ ভাগ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

এরই মধ্যে বেতারের জন্য ২ কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার টাকায় কেনা একটি জেনারেটর  বিকল হওয়ার সত্যতা পায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় প্রকল্প পরিচালকসহ পাঁচ কর্মকর্তাকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল কমিটি। ওই তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বেতারের ঢাকার ধামরাই স্টেশনের জন্য ২ কোটি ৩৭ লাখ ১৭ হাজার ৯৫৩ টাকা ব্যয়ে ১৫০০ কেভি’র একটি জেনারেটর কেনা হয়। অভিযোগ ওঠে কেনার চারদিনের মাথায় বিকল হয়ে যায় জেনারেটরটি। 

• অর্ধকোটি টাকা লোপাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ
• যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাড়ানো হয়েছে ৩১ ভাগ ব্যয়
• ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় কেনা জেনারেটর চারদিনের মাথায় বিকল
• এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দুদকের অনুসন্ধান
• প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই আগাম বিল উত্তোলন

এরপর অনেক চেষ্টা করেও তা ঠিক করতে করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে ঠিক করার নামে যন্ত্রাংশ খুলে রাখা হয়। এছাড়া বার্ষিক অডিটেও জেনারেটরটি বিকল হওয়ার সত্যতা মেলে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) পরিতোষ চন্দ্র দাসকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় সিনিয়র প্রকৌশলী আবুল কালাম মো. খায়ের, প্রকল্প পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম, তৎকালীন জেনারেটর গ্রহণ কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আহম্মদ কামরুজ্জামান, প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার মণ্ডল ও সংরক্ষণ অনুবিভাগের তৎকালীন সিনিয়র প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউনুস আলীকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়। যার সূত্র ধরে এগোচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান।

শিগগিরই অনুসন্ধান শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হবে।

দুদক পরিচালক ও তদারককারী কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন

এ বিষয়ে দুদক পরিচালক ও তদারককারী কর্মকর্তা  সৈয়দ ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানে বেশকিছু অগ্রগতি আছে। তবে এখনই তা প্রকাশ করা যাবে না। অনুসন্ধান কর্মকর্তারা শিগগিরই এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করবেন। 

ইতোমধ্যে অভিযোগ অনুসন্ধানে কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান। তবে এখনও মেলেনি অধিকাংশ নথি। যে কারণে চলতি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আবারও বাংলাদেশ বেতারের তৎকালীন মহাপরিচালক সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ বরাবর চিঠিতে বেশ কিছু তথ্য চেয়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা।

অভিযোগের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেতারের প্রধান প্রকৌশলী আহম্মদ কামরুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট স্টেশন প্রকৌশলী  প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন প্রকল্প অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। 

• বৃক্ষরোপণের ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ
• কেনাকাটার ক্ষেত্রে তিন গুণ বেশি মূল্য দেখানোর অভিযোগ
• ভাড়া করা গাড়ি দেখিয়ে হাতানো হয়েছে মাসে ২০ লাখ টাকা
• ভবন নির্মাণে ‘সাগরচুরির’ অভিযোগ

চাহিদাকৃত রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় বাৎসরিক কেনাকাটার ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বরাদ্দের কপি, যেসব কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ, ট্রান্সমিটার ও অন্যান্য বেতার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে তার বিবরণ, টেন্ডার সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র, খরচ হওয়া অর্থের পরিমাণ ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডপত্র, যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত নথি ও নোটশিটের কপি। 

এছাড়া বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের বাৎসরিক কেনাকাটার ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মেরামত ও কম্পিউটার ক্রয়ে খাতভিত্তিক খরচ হওয়া অর্থের তথ্য এবং মেরামত/ক্রয় ও বিল প্রদান সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে নিম্নশক্তি প্রেরণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ বেতার, কল্যাণপুর, ঢাকা কেন্দ্রের জন্য এফএমএইচডি ট্রান্সমিটার ও যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্তে- টেন্ডার সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি, ভাউচার এবং ক্রয় সংক্রান্ত নথি চাওয়া হয়েছে।

চাহিদাকৃত রেকর্ডপত্রের মধ্যে আরও রয়েছে, বাংলাদেশ বেতার ময়মনসিংহ ও গোপালগঞ্জে দুইটি ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ ১০ কিলোওয়াট এফএম বেতার কেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের বরাদ্দপত্রসহ প্রকল্পের নথি, প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থের খাতভিত্তিক ব্যয়ের তথ্য ও স্বপক্ষের রেকর্ডপত্র, প্রকল্প বাস্তবায়নে ট্রান্সমিটারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত টেন্ডার সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র। 

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রকল্প কাজের কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা নিয়মনীতি উপেক্ষা করে খেয়াল-খুশিমতো কর্মকাণ্ডের নামে অনিয়ম করেছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই বিলও তুলেছেন আগাম। প্রকল্পের জায়গা নির্ধারণ করে সে জমি অধিগ্রহণের আগেই মেশিনপত্রাদি কেনার নামে তারা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। প্রকল্প কাজ চলাকালে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রায় ৩১ ভাগ ব্যয় বাড়িয়ে তার বেশির ভাগই আত্মসাৎ করেছেন তারা।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ৭৬ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে রেডিও কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই মুনীর আহমদ অনিয়ম করে এক টেন্ডার আহ্বান করেন। যে টেন্ডারে তারই ঘনিষ্ঠ একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো ঠিকাদার অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি। নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত ৭৪টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকেও কোনো চিঠি না দিয়ে একক প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। 

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প এলাকায় বৃক্ষরোপণের জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করেও আত্মসাৎ করা হয়েছে। দুটি রেডিও কেন্দ্র এলাকার কোথাও নির্ধারিত আসবাবপত্র, কম্পিউটার, প্রিন্টার, নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার কিছু কেনাকাটা করা হয়নি, কিন্তু সেসব খাতে টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে আগেই। প্রতিটি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অন্তত তিন গুণ বেশি মূল্য দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। এন্টেনার মাস্ট, ফ্লোর, কারপেট, ফায়ার প্রুফ, অ্যাকুস্টিক ডোর কেনা ও স্থাপনের ক্ষেত্রে কয়েক কোটি টাকা তসরুফ করার অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের জন্য ভাড়া করা অতিরিক্ত গাড়ি দেখিয়েই প্রতি মাসে ২০ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। একইভাবে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও হয়েছে ‘সাগরচুরির’ ঘটনা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেতারের বর্তমান মহাপরিচালক আহম্মদ কামরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।

আরএম/এইচকে