নারী, কিশোরী ও শিশুদের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশ অর্জনে তাদের দরকার ভয়মুক্ত জীবন। এজন্য প্রয়োজন তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) কারওয়ান বাজারে একটি ভবনের সেমিনার কক্ষে আয়োজিত 'সহিংসতার ভয়: সেকাল একাল' শীর্ষক এক প্রজন্ম সংলাপে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মানবাধিকার কর্মী এবং যুব প্রতিনিধিদের বক্তব্য-আলোচনায় এমন মন্তব্য উঠে আসে।

সহিংসতার শিকার নারী, কিশোরী ও যুব নারীদের দোষারোপের চর্চা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। তাদের দাবি, আঙ্গুল তুলতে হবে অন্যায়কারীর দিকেই।

সম্প্রতি সহিংসতার ভয় নিয়ে পরিচালিত আইনের বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া চিত্রের ওপর ভিত্তি করে এ প্রজন্ম সংলাপের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের বিদ্যমান নীতিমালা ও আইনকাঠামোতে সহিংসতার ভয় মোকাবিলার সুযোগ অন্বেষণে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় বিশ্লেষণপত্র তৈরি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি তার প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জানান, পারিবারিক বলয়ে পিতৃতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা এখনো রয়ে গেছে। ভয়-ভীতির কারণে মেয়েরা অনেক সম্ভাবনাময় সুযোগ থেকে বিরত থাকে। আশেপাশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সহিংসতার ঘটনা এ ভয়-ভীতির পেছনের কারণ।

তিনি জানান, ভয়-ভীতি থেকে তৈরি হচ্ছে বিষন্নতার সংকট। সবক্ষেত্রে মানিয়ে চলার দায় যেন শুধু মেয়েদেরই। যেকোন ঘটনায় দোষারোপটা আসে মেয়েদের ওপরই। আইন নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু আইনের কাছে আসতে হলে যা দরকার তা সব নারীর জন্য খুব সহজ নয়।

অধ্যাপক হুদা বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ নানা আইন থাকা স্বত্তেও রয়েছে বিচারহীনতার চর্চা। এসবই তৈরি করে সহিংসতার ভয়। প্রতিবাদ ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, আইনের কার্যকারিতা ও বিচার ব্যবস্থার সহজগম্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ ভয়কে জয় করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, যারা সুযোগ পায়নি, তাদের এগিয়ে আনতে হবে। সবাই সমান মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পায় না। মেধা থাকা স্বত্তেও সুযোগ ও পরিবেশের অভাবে তাদের সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশের পথে বাধা তৈরি হচ্ছে। আমাদের মানসিকতায় নানা পর্যায়ে এখনো চিরাচরিত কুসংস্কার রয়ে গেছে। যুবদের এ জায়গায় পরিবর্তন আনার সুযোগ রয়েছে।

আলোচনায় যুব প্রতিনিধি আরিয়ান বলেন, ফিশিং করে তথ্য চুরির মাধ্যমে এক নতুন ধরনের সহিংসতার ভয় তৈরির সুযোগ থাকে। যার প্রভাব অনেক বেশি এসে পড়ে যুব নারী ও কিশোরীদের ওপর। সচেতনতার অভাব অন্যতম বড় কারণ। বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। তাই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে আইনকে আরও শক্ত হতে হবে।

সেমিনারে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক জানান, যুবদের সচেতন হতে হবে। যেকোন ধরনের সহিংসতার শিকার যেকোন ব্যক্তি একটি ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। সহিংসতার এ ভয় যেকোন ব্যক্তির স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান অন্তরায়। তাই ই সহিংসতা নিয়ে কথা বলতে হবে।

যুব প্রতিনিধি তাইফা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে প্রায় সময়ই বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে হয়। আমি প্রতিবাদ করলেও আমি দেখতে পাই সবার মধ্যে এই সাহসটা থাকে না, ভয় কাজ করে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক শিশু বন্ধু আঁখি জানান, পারিবারিক বলয়ে সহিংসতার ভয় দুই রকম- মা-বাবার পরিবারে, আবার শ্বশুড়বাড়িতে। সহিংসতার শিকার ছেলে-মেয়ে উভয় হলেও, মেয়েদের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। ছোটবেলা থেকেই চিরাচরিত স্টেরিওটাইপড চিন্তাভাবনার কারণে ভয়গুলো দৃঢ় হয়, বিস্তার পায়।

আমরাই পারি’র প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ভয় শুরু হয় পরিবার থেকে। মেয়ের প্রতি পরিবার থেকে আরোপিত যাবতীয় বিধিনিষেধ থেকে জন্মে ভয়, যা তৈরি করে নির্ভরশীলতা। স্কুল কলেজ থেকে সমাজ-রাষ্ট্র-সব পর্যায়েই এ ভয়ের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। তাই এই ভয় প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন, হেল্পলাইন নম্বর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে যেন মেয়েরা প্রয়োজনের সময় সহযোগিতা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গার্লস রাইটস হাবের ডিরেক্টর কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে যখন যুবদের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। যুবদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়েই উঠে আসে সহিংসতার ভয়ের কথা। আমরা সহিংসতা নিয়ে অনেক কথা বলি। কিন্তু আলোচনায় ও উদ্যোগে অনুপস্থিত থাকে সহিংসতার ভয়। এই ভয় প্রতিরোধে আমরা আদতে তেমন কোনো কাজ করি না। শুধু সহিংসতা প্রতিরোধেই নয়, বরং এই ভয়কে জয় করে যেন কিশোর-কিশোরী, নারী, শিশু এগিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিতে কাজ করবে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক প্রায় ১০ হাজার অংশগ্রহণকারীর ওপর পরিচালিত এক জরিপে আমরা দেখেছি যে অংশগ্রহণকারীদের ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ নারীদের দাবি তারা জনসামগমস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ নারী বলেছেন তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন পারিবারিক বলয়েই।

কাশফিয়া ফিরোজ জানান, পারিবারিক বলয় ও জনসমাগমস্থলের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ক্ষেত্রে জরিপটি করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অশালীন, ক্ষতিকর মন্তব্যের মাধ্যমে নিপীড়নের ঘটনার কথা জানিয়েছেন ৫৭ শতাংশ আর কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন ৫৬ শতাংশ নারী। এ প্রজন্ম সংলাপে ভয় থেকে বের হওয়ার পথটা দেখতে চেষ্টা করেছি যেখানে দুই প্রজন্মের চিন্তা চেতনার আলোকে আলোচনা শুরু করে ভয় এর বিরুদ্ধে সামনে কাজ করতে চাই দৃঢ়তার সঙ্গে।

জেইউ/এসএম