মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু চিসহ দলটির অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণাও এসেছে। প্রতিবেশী এ দেশটির এ অবস্থার নজর রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কারণ, মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যু।

করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন আলোচনায় ছিল না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বৈঠকের মাধ্যমে আশার আলো দেখা দেয়। বিশেষ করে বৈঠকের পর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা আসে।

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে জানান, বিষয়টি তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতির মাধ্যমে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা হবে।

• মিয়ানমারের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ 
• সু চি আটকের ঘটনায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিবর্তন হবে না
• আজ ভোরে সেনাবাহিনী সু চিকে আটক করে
• জাতিসংঘের তীব্র নিন্দা 
• গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনে সু চির দল বড় জয় পায়
• ফলাফল মেনে নিতে রাজি নয় ইউএসডিপি

বিশ্লেষকরা বলছেন, অং সান সু চি ক্ষমতায় থাকলেও মূলত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ভার দেশটির সেনাবাহিনীর হাতেই ছিল। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে না। সু চি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যে গণহত্যা হয়েছে তাতে রোহিঙ্গাদের ওপর তার বিশেষ ভালোবাসার প্রকাশ নেই।

আমরা চাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন

এদিকে রোববার (৩১ জানুয়ারি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। তবে মিয়ানমারের পাঠানো তালিকা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা দেননি মন্ত্রী।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারের কাছ থেকে কিছু পজিটিভ রেসপন্স পাওয়া গেছে। তারা কিছু রোহিঙ্গা নেবে। আমরা এখন ঐকমত্যে পৌঁছেছি। তারা একটা সংখ্যা দিয়েছে। এটা তো একদিনে যাবে না। নেওয়ার প্রসেসটা শুরু হবে। মোটামুটি আমরা চাই প্রত্যাবাসন শুরু হোক।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা ও নেইপিডোর ডিজি পর্যায়ে বৈঠকের কথাও জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত কয়েক দিন ধরেই মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার ও ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছিল। সেনাবাহিনী আগে থেকেই অভিযোগ করছিল, গত নির্বাচনে জালিয়াতি করে ক্ষমতায় এসেছে এনএলডি।

অবশেষে এই টান টান উত্তেজনার মধ্যে আজ সোমবার ভোরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অং সান সু চি ও জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে। পরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি সরকারকে হটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী। তারা দেশটিতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণাও দেয়।

মিয়ানমারের ভেতরে কী ঘটল তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। সত্যিকার অর্থে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিল।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মিয়ানমারের ভেতরে কী ঘটল তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। সবাই জানে সত্যিকার অর্থে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিল। সামনে একটা প্রাসাদ ছিল তাদের ফ্রিল্যান্ড গভমেন্টে। সেই প্রাসাদটা এখন সরে গেছে। অং সান সু চির প্রতি আমাদের কোনো ধরনের ভালোবাসা থাকার কারণ নাই। কারণ, রোহিঙ্গাদের ওপর যখন গণহত্যা হয়েছে তখনও তো সু চি ক্ষমতায়। মিলিটারি যখন ক্ষমতায়, আংশিক ক্ষমতায় যখন সু চি- তখন সবচেয়ে বড় গণহত্যাটা হয়েছে। কাজেই তার প্রতি আমাদের আলাদা ভালোবাসার কোনো কারণ নেই।’

মিয়ানমারের এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না জানতে চাইলে সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘এ কারণে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বড় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। কারণ আগেও এই ইস্যুতে কী হবে না হবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নিত, এখনও তাই হবে। সব মিলিয়ে আমি তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।’

অং সান সু চির প্রতি আমাদের কোনো ধরনের ভালোবাসা থাকার কারণ নেই।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন

গত ৮ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বড় জয় পায়। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ৩২২টি আসনই যথেষ্ট, সেখানে এনএলডি পেয়েছে ৩৪৬টি আসন। কিন্তু সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে।

সু চিকে ছেড়ে না দিলে মিয়ানমারের দায়ী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

এদিকে সু চিসহ দলটির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের ছেড়ে দিতে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে বলেছে, সু চিসহ অন্যদের ছেড়ে না দিলে মিয়ানমারের দায়ী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে সু চির আটকের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সেটা আরও পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া আপাতত কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না। তবে একটা বিষয় হচ্ছে, সু চি ক্ষমতায় থাকলেও মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ তো সেনাবাহিনীর কাছে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।’

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আগে থেকেই দেশে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিলেন। 

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইনের বিরূপ পরিবেশ নিয়ে শঙ্কায় ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের ফেরানোর বিষয়ে গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে। সেখানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অঞ্চলভিত্তিক প্রত্যাবাসন চাইলেও মিয়ানমার ২০১৭ সালের করা চুক্তির পক্ষেই থাকে।

এনআই/এইচকে