‘পিপলস’ থেকে গিয়াস কাদের পরিবারের ২২ কোটি টাকা লোপাট
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফসিএল) থেকে ফ্ল্যাট ক্রয় ও নিজ কোম্পানির নামে প্রায় ১২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার। যা সুদ-আসলে প্রায় ২২ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরের বিভিন্ন সময় নেওয়া ওই ঋণ আর ফেরত দেননি তারা। বর্তমানে পরিবার নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, ছেলে সামির কাদের চৌধুরী ও মেয়ে সামিহা কাদের চৌধুরীর নামে গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য মোট আট কোটি টাকা নেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। বাকি টাকা নিজের জন্য নেন। যা পিপলস লিজিংয়ের খাতায় অনাদায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে আছে। দুদক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য।
বিজ্ঞাপন
২ ফেব্রুয়ারি তাদের তলব করে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চেয়েছেন। যেখানে ওই আইনজীবী জানিয়েছেন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন
গুলশান আনোয়ার প্রধান, অনুসন্ধান কর্মকর্তা, দুদক
দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান গতকাল মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে তলব করেছিলেন। কিন্তু তারা হাজির হননি। ওইদিন দুপুরে তাদের পক্ষে একজন আইনজীবী এসে লিখিত আবেদন করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তারা সিঙ্গাপুর অবস্থান করায় হাজির হতে পারছেন না। তাই করোনাকালীন দেশে না ফেরা পর্যন্ত সময় দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করছি।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২ ফেব্রুয়ারি তাদের তলব করে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চেয়েছেন। যেখানে ওই আইনজীবী জানিয়েছেন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবার নিয়ে সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। তবে আইনজীবী যখন আবেদন দেন, তখন আমি উপস্থিত ছিলাম না।’
দুদক সূত্রে জানা যায়, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফসিএল) থেকে ২০০৯ ও ২০১০ সালের বিভিন্ন সময়ে গুলশানের দুটি ফ্ল্যাট কেনার নামে চার কোটি টাকা করে মোট আট কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ছেলে সামির কাদের চৌধুরী ও মেয়ে সামিহা কাদের চৌধুরীর নামে ওই ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনলেও তা পরিশোধ করেননি তারা। এছাড়া গিয়াস কাদের চৌধুরীর মালিকানাধীন ঢাকা ডাইং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের নামে আরও পাঁচ কোটি টাকাসহ ১২ কোটি টাকা নেওয়া হয়। যা সুদে-আসলে প্রায় ২২ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ওই ঋণ আদায় হবার নয়। আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) সহযোগী হিসেবে তাদের মনে করছে দুদক। এ কারণেই তাদের বক্তব্য প্রয়োজন। অনুসন্ধানে আরও তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ছেলে সামির কাদের চৌধুরী ও মেয়ে সামিহা কাদের চৌধুরীর নামে গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য মোট আট কোটি টাকা নেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। বাকি টাকা নিজের জন্য নেন
প্রসঙ্গত, উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই।
অভিযোগ রয়েছে, পি কে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন।
ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের পরপরই প্রশান্ত কুমার হালদারের নাম উঠে আসে। ২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঠিকই দেশ থেকে পালিয়ে যান। পরে দেশে আসার কথা বলেও আর আসেননি। এর মধ্যে গত ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে ইন্টারপোল।
এছাড়া গত ২৫ জানুয়ারি পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্তার বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা করে দুদক। আসামিরা হলেন- রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার), আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমিতাভ অধিকারী, পরিচালক প্রিতিশ কুমার হালদার, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পূর্ণিমা রানী হালদার, রাজীব সোম, রতন কুমার বিশ্বাস ও পরিচালক ওমর শরীফ।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের সাবেক এমডি রাশেদুল হক ছাড়াও ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আনোয়ারুল কবীর, নুরুল আলম, নাসিম আনেয়ার, মো. নুরুজ্জামান, এম এ হাশেম, মোহম্মদ আবুল হাসেম, জহিরুল আলম, পরিচালক নওশেরুল ইসলাম, বাসুদেব ব্যানার্জি ও তার স্ত্রী পাপিয়া ব্যানার্জি, মিজানুর রহমান, একই প্রতিষ্ঠানের সাবেক ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ আবেদ হাসান, ভাইস প্রেসিডেন্ট নাহিদা রুনাই, অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আল মামুন সোহাগ, সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী ও কোম্পানির সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, রাহমান কেমিক্যাল লিমিটেডের পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রি, কাজী মমরেজ মাহমুদ, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম, মেসার্স বর্ন লিমিটেডের মালিক অনঙ্গ মোহন রায়, মুন এন্টারপ্রাইজের মালিক সঙখা বেপারিকে আসামি করা হয়।
মামলার অভিযোগে আনান কেমিক্যাল লিমিটেডের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা, সুখাদা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নামে ৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, মেসার্স বর্নের নামে ৬৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, রাহমান কেমিক্যালস লিমিটেডের নামে ৫৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
এরই মধ্যে পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারি ও রাশেদুল হক ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আরএম/এসএম