ছবি : সংগৃহীত

১০ মার্চ রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের ইয়াছিন খান (৭) ও মোরসালিন খান (৫) নামের দুই শিশু মারা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। তিনি সিলেটের একটি ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তার স্ত্রী লিমা বেগম কাজ করেন আশুগঞ্জের একটি চাল কলে। অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। টাকার অভাবে জ্বরে আক্রান্ত দুই শিশু সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি তারা। বাড়ির পাশের একটি ফার্মেসি থেকে নাপা সিরাপ এনে খাওয়ান। সেই সিরাপ খাওয়ানোর পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে শিশু ইয়াছিন ও মোরসালিন। পরে তাদের দুজনেরই মৃত্যু হয়। (ঢাকা পোস্ট, ১৩ মার্চ ২০২২)

উল্লেখ্য যে, জ্বর ও ব্যথানাশক ওষুধ প্যারসিটামল-এর সর্বাধিক জনপ্রিয় ও গুণগত মানসম্পন্ন যে ব্র্যান্ডগুলো বর্তমানে দেশের বাজারে পাওয়া যায় তার মধ্যে ‘নাপা’ অন্যতম।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া দুই শিশুকে যে নাপা সিরাপ খাওয়ানো হয়েছে সেই ব্যাচের সিরাপ ঝুঁকিমুক্ত ও মানসম্মত ছিল। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে ‘নাপা সিরাপে শিশুমৃত্যুর অভিযোগ’ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ। (ঢাকা পোস্ট, ১৪ মার্চ ২০২২)

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার অভিযানে মাঝে মাঝেই এই ধরনের নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ধরা পড়ছে। কিন্তু কোনোক্রমেই এই সমস্ত নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ‘নাপা’ সিরাপ সেবনে কেন শিশুমৃত্যু ঘটলো? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ হলো ‘নকল’ ওষুধ। কারণ দেশের স্বনামধন্য ও প্রথিতযশা কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির কিছু ওষুধ ‘নকল’ করা হচ্ছে বলে প্রায়শই গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার অভিযানে মাঝে মাঝেই এই ধরনের নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ধরা পড়ছে। কিন্তু কোনোক্রমেই এই সমস্ত নকল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। সারাদেশেই বিশেষ করে মফস্বল এলাকাগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো ড্রাগ লাইসেন্স বিহীন ওষুধের দোকানে এই ধরনের মানহীন এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে তৈরি ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।

প্রশাসনের নজরদারির মধ্যেই অপরাধীরা তাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও জব্দকৃত সেই সিরাপটি পরীক্ষা না করলে এই মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়, তথাপি অতীতের কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করে এর কারণ সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে। যেমন, আশির দশকের শেষের দিকে প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডির কথা আমাদের মনে থাকার কথা। ভেজাল ও নিম্নমানের প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে প্রায় ২৭০০ জন শিশুর কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটেছিল। যে সলভেন্ট বা দ্রাবক ব্যবহার করে এই সিরাপ তৈরি করা হয়েছিল তা কিডনি ও লিভার অকেজো করে ফেলে, যা শিশু মৃত্যুর কারণ।

খুবই স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় বিধায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল নামের এই বিষাক্ত দ্রাবকটি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘঠিত ঘটনাও অনুরূপ কোনো কারণে ঘটতে পারে। গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ওষুধ সংক্রান্ত সকল কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্ব ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য মামলা দায়ের ও পরিচালনা করার দায়িত্বও সরকারের এই প্রতিষ্ঠানের।

দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সঠিক ধারায় মামলা না হওয়া, মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট আন্তরিক না হওয়া এবং বিচারালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা অনেক ক্ষেত্রে পার পেয়ে যায়, থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফলে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি কোনোদিনও বন্ধ হয় না। নকল ও ভেজাল ওষুধ বন্ধে প্রয়োজন সুষ্ঠু ও যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন।

খুবই স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায় বিধায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল নামের এই বিষাক্ত দ্রাবকটি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যাবে? এ বিষয়েও ইতিপূর্বে অনেক আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার নিয়ে এর পূর্বে একটি লেখায় আলোচনা করেছিলাম যার কিছুটা পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন।

নকল ওষুধ তৈরি ও সরবরাহ বন্ধ করতে হলে তিনটি ধাপে কাজ করতে হবে। প্রথমত, কোনো লাইসেন্স প্রাপ্ত অথবা লাইসেন্স বিহীন কোম্পানি যাতে নকল ওষুধ তৈরি করতে না পারে সেই ব্যাপারে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রস্তুতকৃত নকল ও ভেজাল ওষুধ যেন বাজারে সরবরাহ না হয় সে লক্ষ্যে দেশের বাজারগুলো ব্যাপক নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

উল্লেখ্যে, গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বিক্রি বন্ধ করতে সরকার ২০১৬ সালে সারদেশে ‘মডেল ফার্মেসি’ ও ‘মডেল মেডিসিন শপ’ চালুর কার্যক্রম গ্রহণ করে। যেখানে প্রতিটি মডেল ফার্মেসিতে ওষুধ ডিস্পেনসিং এর জন্য ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ সমস্ত ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি অনেকাংশে কমে যাবে।

তৃতীয়ত, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সঠিকভাবে ও দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

পরিশেষে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই, সাধারণ মানুষের পক্ষে ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের ওষুধ চেনা খুবই দুরূহ। ওষুধের দোকানে কর্মরত ফার্মাসিস্টরা যেটি সহজেই শনাক্ত করতে পারেন। সে কারণে সকলের উচিত যথাসম্ভব নিকটস্থ ‘মডেল ফার্মেসি’ অথবা ‘মডেল মেডিসিন শপ’ থেকে ওষুধ ক্রয় করা। কারণ এই দুই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের বিশেষ তদারকির অন্তর্ভুক্ত।

সাধারণ জনগণের পক্ষে কোনো ক্রমেই ভেজাল ও নকল ওষুধ শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভবপর নয়। এটি করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়