ছবি : সংগৃহীত

বাংলা ভাষায় ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বলতে একটি প্রবাদ আমরা সবাই জানি। সামান্য কেঁচো খুঁজতে গিয়ে যখন আস্ত বিষধর সাপ বের হয়ে আসে, সেটা ভয়েরই কথা। কিন্তু, প্রবাদ-প্রবচনও, হায়, ‘সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ’-এর অমোঘ যাদু বাস্তবতার শক্তিকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। নাহ্, ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়েই বলা যায় যে গত ১৫ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ী জনৈক আমির হামজার রাত না পোহাতেই সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তার মৃত্যু পূর্ব সময়ে খুনের মামলার আসামি হিসেবে যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়ার সংবাদ এদেশের ১৭ কোটি মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। এবং সত্যি বলতে এই ঘটনা যেন ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ নয়, আমাদের সামনে হাজির করেছে আস্ত একটি ‘জুরাসিক পার্ক।’ 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের নানা স্তরেই মাথা মোটা, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের জন্য অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটলেও এবার সাহিত্যে ‘স্বাধীনতা পদক-২০২২’ ঘোষণা শুরুতে কমেডি ও পরে আমাদের সম্মিলিত জনমানসে যে হিম আতঙ্কের জন্ম দিল, তা এক কথায় বিরল। 

সাহিত্যে আমির হামজা নামে একদমই অজ্ঞাত ও অখ্যাত এক ব্যক্তির নাম ঘোষণা হওয়ায় মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম থেকে সামাজিক মাধ্যমে নেটিজেনরা বিস্ময়-বিদ্রূপ-ক্ষোভ ও কৌতুকে ফেটে পড়ে। তবু এই জনৈক আমির হামজার স্বাধীনতা পদক পাওয়ার খবর প্রথম দিন অন্তত সামাজিক মাধ্যমে ছিল সবার হাস্যরস বা কৌতুকের উপাদান।

একদিন যেতে না যেতে ‘হরিষে বিষাদ’ নয়, দেখা দিল ‘হরিষে আতঙ্ক।’ চলুন, আমাদের ‘হরিষে বিষাদ’ থেকে ‘হরিষে আতঙ্ক’-এ উপনীত হওয়ার দুই স্তরই একটু ডাল-পালা মেলে বর্ণনা করি—

ঠিক কোন দুটো বই লেখার জন্য আমির হামজা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন?

সেই চর্যাপদের সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ হয়ে আজ এপার ওপার মিলিয়ে দুই বাংলা ও বরাক উপত্যকাসহ আসাম-ত্রিপুরা পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য অদ্যাবধি বিকশিত হয়ে চলেছে তার কোটি পুষ্পের সমাহারে। বাঙালি ইউরোপীয়দের মতো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ না হোক, এশিয়ার প্রথম নোবেল এসেছে বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের নানা স্তরেই মাথা মোটা, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের জন্য অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটলেও এবার সাহিত্যে ‘স্বাধীনতা পদক-২০২২’ ঘোষণা শুরুতে কমেডি ও পরে আমাদের সম্মিলিত জনমানসে যে হিম আতঙ্কের জন্ম দিল, তা এক কথায় বিরল। 

কবিতা-ছোট গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধসহ তার সাহিত্য নির্ঝরিণীর রয়েছে অনেকগুলো বাঁক। বাংলা সাহিত্যকে সম্মান করে উপমহাদেশের অন্য সব ভাষার লেখকেরা। আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলা কিন্তু রাষ্ট্রভাষা এই আমাদের বাংলাদেশেরই।

১৯৪৭-এর পর থেকে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান ও আজকের বাংলাদেশেও গত ৭৫ বছরে গড়ে উঠেছে সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সম্ভার। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এদেশে বর্ষীয়ান ও তরুণ বহু যোগ্য লেখক থাকা সত্ত্বেও ইদানীং মাঝে মাঝেই এমন কেউ কেউ সাহিত্যে ‘স্বাধীনতা পদক’, ‘একুশে পদক’ বা এমনকি ‘বাংলা একাডেমি’র মতো পদক পেয়ে যাচ্ছেন, যা সবার চোখ কপালে তুলতে বাধ্য করে।

সাম্প্রতিক কয়েকটি বছরে কয়েকজন যোগ্য লেখক ‘বাংলা একাডেমি’ পদক পাওয়ায় মানুষ হালে আবার এই পদকের প্রতি হৃত আস্থা ফিরে পেতে শুরু করলেও অতীতে ‘বাংলা একাডেমি’ পদকও বেশ কয়েকবারই খুবই অনালোচিত এবং বলতে গেলে অলেখক বা অকবিদের হাতে গেছে।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঠিক যেমন প্রাইভেট হাসপাতালের গলা কাটা দাম সত্ত্বেও মানুষ পাবলিক বা সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট হাসপাতালেই ছোটে, রাষ্ট্রীয় সাহিত্য পুরস্কারের বদলে আজকাল কর্পোরেট মিডিয়া প্রবর্তিত পুরস্কারগুলোই তবু কোনো কোনটা খানিকটা মান রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। 

তা এত আলোচনার আমির হামজা এবার কোন দুটো বইয়ের বদলে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন? এই বই দুটো ছিল ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি।’ বই দুটো আবার বের হয়েছিল এই সেদিন- ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। আরও মজার বিষয় হলো যে, ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় আমির হামজা যখন মারা যান, তখন ‘বাঘের থাবা’ নামে কবিতা ও গানের এই বই তিনি শুধু দেখে যেতে পেরেছেন। তবে এই দুটো বইও আবার মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক প্রকাশনা সংস্থা থেকে।

আমির হামজা এবার কোন দুটো বইয়ের বদলে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছিলেন? এই বই দুটো ছিল ‘বাঘের থাবা’ ও ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি।’ বই দুটো আবার বের হয়েছিল এই সেদিন- ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে।

২০১৮ সালে ‘বাঘের থাবা’ নামে আমির হামজার যে বই বের হয়, তার প্রকাশক ছিল মাগুরার শ্রীপুরের সারথি ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর বইয়ের মুদ্রণ ব্যবস্থাপনায় ছিল ঝিনাইদহের বেগবতী প্রকাশনী। তখন আমির হামজার মেজ ছেলে মো. আসাদুজ্জামান ছিলেন ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। বর্তমানে তিনি উপসচিব। খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত। তিনি জানান, ‘ঝিনাইদহে চাকরি করার সময় ২০১৮ সালের বইমেলার সময় প্রথমে আমরা ‘বাঘের থাবা’ বইটি সারথি ফাউন্ডেশন থেকে বের করি। পরে ২০১৯-এ এই বইয়ের গান অংশটুকু ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ এবং কবিতা অংশটুকু ‘বাঘের থাবা’ নাম দিয়ে আলাদা দুটি বই হিসেবে আবার বের হয় অন্যপ্রকাশ থেকে। পরে ২০২১ সালে ‘একুশের পাঁচালি’ নামে আমির হামজার আরও একটি বই বের হয়েছে বলে তার ছেলে জানান।

মো. আমির হামজার জন্ম ১৯৩১ সালের ৩ মে, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে। গত শতকের ষাট দশক থেকে আশির দশক অবধি তিনি পালাগান, কবিগান করতেন বলে শ্রীপুরের স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। অবশ্য তার ছেলে আসাদুজ্জামান তার বাবাকে কবিয়াল বিজয় সরকারের শিষ্য বলে দাবি করেছেন। ছয় ছেলে ও তিন মেয়ের জনক আমির হামজা ব্যবসা ও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘আকবর বাহিনী’র একজন যোদ্ধা ছিলেন।

জীবদ্দশায় আমির হামজার কোনো লেখা সেভাবে কোথাও কোনো মানসম্মত জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি বলে জানা যায়। এর সূত্র ধরে আমির হামজার গ্রামের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, তাকে স্বাধীনতা পদকের ‘যোগ্য’ করে তোলার জন্যই ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তড়িঘড়ি করে এসব বই বের করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন একজনের ভাষ্য, ‘২০১৮-এর পর থেকে দেখলাম আমির হামজার ছেলে আসাদ তার বাবার বই বের করা নিয়ে খুব তোড়জোড় করছেন, একের পর এক বই বের করছেন। তখন ভেবেছিলাম, হয়তো বাবার বই ছেলের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগবে, তাই এমন করছেন। কিন্তু এখন দেখি ঘটনা অন্য।’ (প্রথম আলো, ১৫.৩.২০২২)

অবশেষে কেঁচো খুঁড়তে জুরাসিক পার্ক:

১৫ মার্চ সারাদিন তবু নানা হাস্যরস ও বিরক্তির ভেতর দিয়ে গেছে। ১৬ মার্চ সকালে জাতি মুখোমুখি হলো এক বিকট বজ্রাঘাতের।  দেশের নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেল স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক আমির হামজা ছিলেন এক খুনের আসামি।

মাগুরার শ্রীপুরের বরিশাট গ্রামে ১৯৭৮ সালে খুনের ওই ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় মো. আমির হামজাসহ ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। নিহত ব্যক্তির স্বজন ও দণ্ডিত অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তবে খুনের মামলার আসামি হওয়ার কথা স্বীকার করলেও সেই মামলায় আমির হামজার দণ্ড পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন তার বড় ছেলে মো. আলী মর্তুজা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে, জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘একটি খুনের মামলায় আমির হামজার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি শুনেছি। এ নিয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে।’

১৬ মার্চ সকালে জাতি মুখোমুখি হলো এক বিকট বজ্রাঘাতের।  দেশের নানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেল স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক আমির হামজা ছিলেন এক খুনের আসামি।

মো. শাহাদাত হোসেন ফকির নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন আমির হামজা। ওই ব্যক্তির বাড়ি আমির হামজার গ্রাম শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট পূর্ব পাড়ায়। ১৯৭৮ সালে জমির ধান কাটা নিয়ে বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন শাহাদত ফকির।

নিহত শাহাদত ফকিরের ছেলে মো. দিয়ানত আলী ফকিরের (৬৪) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা মামলার প্রায় সাত বছর পর ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন মো. আমির হামজা, তার ভাই গোলাম রব্বানী সরদার, হাসেম মোল্লা, নুরুল মোল্লা, ওমেদ চৌধুরী ও আফজাল মোল্লা। তাদের সবার বাড়ি বরিশাট গ্রামে। (প্রথম আলো, ১৬.৩.২০২২)

মাগুরা জেলার সক্রিয় কয়েকজন রাজনীতিবিদের তথ্যমতে, একটা সময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আমির হামজা। ওই সময় মাগুরায় বিএনপির এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। স্থানীয় অনেকের ধারণা, ওই মন্ত্রীর ‘তদবিরেই’ জেল থেকে ছাড়া পান আমির হামজাসহ অন্যরা।

মুচিরাম গুড়ের সময়:

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য স্যাটায়ার চরিত্র মুচিরাম গুড় সম্পর্কে প্রথমে জানি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির বাংলা র‌্যাপিড রিডিং ক্লাসে। অযোগ্যরাই সমাজে কীভাবে সর্বোচ্চ যোগ্য তারই বিস্তারিত বয়ান।

ব্রিটিশ সাহেবের কাছে চাকরির আবেদন লেখার সময় ইংরেজি লিখতে না পারা মুচিরাম তার হয়ে আবেদন লিখে দেওয়া ব্যক্তিকে বলেন যে, আবেদনপত্রের ইংরেজি যেন খুব ভুল বা দুর্বল হয় আর গোটা পঁচিশ ‘মাই লর্ড’ বা ‘ইয়োর লর্ডশিপ’ থাকে। মুচিরামই চাকরি পায়। সাহেব সব উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও কোলরিজ সড়গড় প্রার্থীদের হঠিয়ে দেন এই বলে যে, এই সামান্য চাকরিতে শেক্সপিয়ার জানার দরকার নেই। 
প্রশ্ন হলো, দেশের চামড়া শিল্প থেকে সাহিত্য ও ললিত কলা অবধি সব খাতকে মুচিরাম গুড়দের হাত থেকে বাঁচাবে কে?

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক