ছবি : সংগৃহীত

মহারাজ, ভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব? অভয় দিলে বলতে পারি যে, আমার পরিবার, বাড়ির ছেলেমেয়েদের পাঠাভ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত কঠোর, শুচিবায়ুগ্রস্ত ও ধ্রুপদি মেজাজের।

সরকারি চাকুরে বাবার আগ্রহ ছিল বাংলা ও ইংরেজি পত্র-পত্রিকার খানিকটা খেলার খবর ও মূলত, রাজনৈতিক খবর ও কলাম পাঠে অথবা বই পড়লেও নন-ফিকশন নানা রাজনৈতিক ইতিহাসের বই, মা’র ঝোঁক বঙ্কিম-বিভূতি-রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে শুরু করে মহাশ্বেতা দেবী পড়তে পড়তে বিস্মিত মন্তব্য যে, এমন লেখা অনেক ‘পুরুষ’ লেখকেরাও লিখতে পারেন না। আর আমার পাঠরুচির বাকিটা অবশ্যই বয়সে আমার বেশ খানিকটা বড় ভাই-বোনদের হাতে নির্মিত।

বাংলা অনুবাদে অসংখ্য রুশ বই। ক্লাস থ্রি’র আমার জন্য নানা রঙের ছবির ‘বাহাদুর পিঁপড়ে’-র রুশ থেকে বাংলা অনুবাদ যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ছুটিতে আসার সময় বড় দিদি হাতে করে নিয়ে আসছে, সেই আমিই তেরোতে পৌঁছতে না পৌঁছতে বাংলা অনুবাদে তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন’ বা ‘পুনর্জন্ম’ পড়ে ফেলছি।

সেটা পড়ার পর ষোলতে ‘দেবদাস’ বা ‘দত্তা’ খুব যে মন টানছে এমন না। এমন পরিবারের মেয়ে হিসেবে ‘সেবা’ প্রকাশনী ছিল ছাত্র ইউনিয়ন-উদীচী-সিপিবি ভক্ত আমাদের পরিবারে বলতে গেলে নিষিদ্ধ বস্তু। তবু নীলের উপর ‘সেবা’র সেই সাদা প্রতীকের একটি বই একবার আমাদের সেই কঠোর শুচিবায়ুগ্রস্ত পরিবারে কীভাবে যেন ঢুকে গেল। বইটি ছিল জুলভার্ন (Jules Verne)-এর ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’। ঘোর লাগা বিস্ময়ে পড়ে ফেললাম ক্যাপ্টেন নিমোর কাহিনি।

নটিলাস জাহাজ, হারপুন দিয়ে তিমি শিকারি নেড, শ্রীলঙ্কার উপকূলের কাছে এসে মুক্তো সংগ্রহ, তামাকের বদলে সমুদ্রের শ্যাওলা দিয়ে বানানো চুরুট- সে এক অকল্পনীয় বিস্ময়ের পৃথিবী! তার পরতে পরতে বোবা করে দেওয়া সৌন্দর্য ও রূপময়তা! কিন্তু এরই ভেতরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বাবার কথায় ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়া এবং পরের বছরই বিদ্রোহ করে যে ঢাকায় বুয়েটে বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে সেই দাদা চট্টগ্রাম থেকে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে জুলভার্নের বেশ কয়েকটি বই (বোধ করি একটি সংগ্রহ হিসেবে ছিল) কিনে নিয়ে এলো।

নীলের উপর ‘সেবা’র সেই সাদা প্রতীকের একটি বই একবার আমাদের সেই কঠোর শুচিবায়ুগ্রস্ত পরিবারে কীভাবে যেন ঢুকে গেল। বইটি ছিল জুলভার্ন-এর ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’। ঘোর লাগা বিস্ময়ে পড়ে ফেললাম ক্যাপ্টেন নিমোর কাহিনি।

দেখলাম যে, এই বইয়ের কাগজ ধবধবে সাদা, ‘সেবা’র মতো নিউজপ্রিন্টের কাগজ না। বাংলাদেশের তুলনামূলক কম পাঠানুরাগী সমাজে নিউজপ্রিন্টের কাগজে, স্বল্প দামের বই না হলে যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার বিকল্প একজন প্রকাশকের ছিল না, সেটা বোঝার মতো বয়স তখনো আমার হয়নি। ফলে আমার রাগ হলো এই ভেবে যে, কেন পশ্চিম বাংলার বইয়ে এমন ঝকঝকে সাদা কাগজ আর আমাদের দেশের বইয়ে কেন নিউজপ্রিন্ট? তা অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে পড়ে ফেলা হলো, ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’সহ জুলভার্নের আরও কিছু বই। সব মিলিয়ে আমাদের কঠোর পরিবারে সেই একটিই ‘সেবা’র বই। কিন্তু বাকি সময়টা বাসায় বড় ভাইবোন ‘সেবা‘ নিয়ে একটু শুচিবায়ুতাই প্রকাশ করে।

এই করতে করতে আমরা শহর বদলাই। বাবার অবসরের পর মফস্বলের বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় আসি। ঢাকার কলেজে বা এগারো ক্লাসে একটি বই দেখি মেয়েদের হাতে হাতে ঘুরছে। কি সেই বই? ‘সেবা’র বই-ই। ‘মাই লাভ’। সেটা দেখে আড়ালে ক্লাসের তিনটি নাক-উঁচু মেয়ে আমরা হাসাহাসি করি। আমরা কি না তখন ‘ন হন্যতে’ থেকে ‘সিটি অফ জয়ে’-র বাংলা অনুবাদ বা জার্মান বাহিনীর হাতে ইহুদি হলোকাস্টের উপর বই পড়ছি। আর এরা পড়ছে ‘মাই লাভ’?

তবু একদিন ক্লাসের মেয়েরা আমাকে ধরল। ‘সেবা’-র বই নিয়ে কেন আমার এত নাক উঁচু ভাব? না খেয়েই আমি কি করে একটি খাবারকে বাতিল করি? কাজেই পড়তে হলো।

পাড়ার গুণ্ডা টাইপের ছেলের সাথে পাড়ার ভদ্রতম, সুন্দরীতমা মেয়েটির কী করে প্রেম হয় তার কাহিনি। পড়ে আমি খুবই বিরক্ত। আমি তখন কলেজ লাইব্রেরিতে আলমারির অভাবে কার্পেটে মেয়েদের কেডসের নিচে ঘষা খাওয়া এডিথ হ্যামিলটনের অনুবাদে ‘থ্রি গ্রিক প্লেইজ’...সত্যি বলতে...চুরি করেই বাসায় নিয়ে ‘ইউরিপিদিস’র ‘দ্য ট্রোজান ওমেন’ অনুবাদ করার চেষ্টা করছি।

তা সেই আমি তখন কি না মাত্র সাহস করে ইংরেজিতেও ‘বরিস পাস্তেরনাক’ বা ‘টমাস মানের ‘দ্য হলি সিনার’ পড়ার চেষ্টা করছি। ‘মাই লাভ’ আমার কেন ভালো লাগবে? এরপর সব মিলিয়ে ‘সেবা’র তৃতীয় আর একটি বই-ই পড়া হলো। সেটাও কলেজ সহপাঠীদের প্রবল অনুরোধে।

‘সেবা’ যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ পাই যখন এদেশে বসে নাক কুঁচকালেও ওপার বাংলার কোনো কোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বন্ধু আমার কাছে জানতে চান যে, ‘সেবা’র অনুবাদে এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘থ্রি কমরেডস’ তিনি কীভাবে পাবেন?

‘মাসুদ রানা’ ইতালিতে গেছে। যে ইতালীয় পরিবারে এক মাফিয়া ব্যবসায়ীর বাসায় সে অতিথি, সেই মাফিয়া ব্যবসায়ীই তার সুন্দরী স্ত্রী লরাকে পাঠাচ্ছে মাসুদের কাছে, যেন মাসুদ রানা তাদের ব্যবসার বিরুদ্ধে সত্যের খড়গ নিয়ে না দাঁড়ায়! কিন্তু বাড়ির নিষ্পাপ কিশোরী মেয়েটি মাসুদ রানার প্রেমে পড়ে।

মাসুদ রানা মেয়েটিকে অথবা মেয়েটিই মাসুদ রানাকে কোরআনের আয়াত লেখা স্বর্ণের চেইন উপহার দেয়। শেষমেশ মাসুদ রানা মাফিয়াদের আস্তানা ধ্বংস করতে পারলেও কিশোরী ইতালীয় মেয়েটি...লুবনাই নাম ছিল...গোলাগুলিতে মারা যায়। তখন আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে লুবনার মুখে শোনা একটি ইতালীয় গানের কথা মনে পড়ে মাসুদের।

এই বইয়ের পাশাপাশি বারো ক্লাস অবধি বাংলা মাধ্যমের আমি তখন কঠোর ধৈর্যে ইংরেজিতেই টমাস মান’র ‘দ্য হলি সিনার’ পড়ছি। সহোদরাকে অন্তঃসত্ত্বা করা ভাই প্রায়শ্চিত্ত করতে উঠছে এক ধু ধু বিরান, মরুতূল্য পাহাড়ে। শুরু হচ্ছে, তার বছরের পর বছরের প্রায়শ্চিত্তের কঠোর ধারা বিবরণী। সেই বিবরণ প্রতিটি রোমকূপ কাঁপিয়ে দেয়।

ফিওদর দস্তয়েভস্কির বইগুলোও ইংরেজিতে পড়া শুরু করছি। এটা কেউ বিশ্বাস করলে করবেন, না করলে না করবেন। কিন্তু আমার পড়াশোনা তো সব তেইশ থেকে চব্বিশ পর্যন্তই। চাকরিতে ঢোকার পর থেকে আমি আর পড়লাম কই?

হ্যাঁ, এখন একটা কথা বলি। আমি হয়তো বেশ খানিকটা পাঠানুরাগী পরিবারের মেয়ে বলে ‘মাসুদ রানা’ বা ‘সেবা’ আমার কাছে তত গুরুত্ববহ মনে হয়নি। কিন্তু যে পরিবারে বঙ্কিমের তেরোটি উপন্যাস ছিল না বা প্রগতি প্রকাশনীর বই ছিল না? অ্যাডগার এ্যালান পো যারা শৈশবেই বাংলা অনুবাদে পায়নি? পায়নি বাংলা অনুবাদে ভলতেয়ারের ‘কাঁদিদ’? তাদের জন্য ‘সেবা’ অনেক বড় পাওনা।

কাজী মোতাহার হোসেনের পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন যার দুই সহোদরাও এদেশে রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুই জীবিত কিংবদন্তী, অবশ্যই প্রকাশনা ভুবনে বিপুল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে শেষজীবনে ‘সেবা’রই অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম ‘সেবা’র অধিকাংশ বইয়ের ‘ঘোস্ট রাইটার’ বা ‘ঘোস্ট ট্রান্সলেটর’ ছিলেন জানার পর থেকে অন্য অনেকের মতো আমিও বেদনায় বিমূঢ় হয়েছি।

সবকিছুর পরও ‘সেবা’ যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ পাই যখন এদেশে বসে নাক কুঁচকালেও ওপার বাংলার কোনো কোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বন্ধু আমার কাছে জানতে চান যে, ‘সেবা’র অনুবাদে এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘থ্রি কমরেডস’ তিনি কীভাবে পাবেন? ‘প্রগতি প্রকাশনী’র কাছে আশৈশব গর্বিত ‘জিম্মি’ এই পাঠক তখন বুঝতে পারে যে বাংলাদেশের ‘সেবা’ও খুব কম কিছু নয়!

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক