জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে এবং এখনো বিভিন্ন পরিসরে হচ্ছে তা একজন মন্ত্রীর জন্য অবশ্যই বিড়ম্বনার। গত শনিবার সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা। স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন অনিয়ম, অক্সিজেন সংকটে বিভিন্ন হাসপাতালে মানুষের মৃত্যু, করোনা চিকিৎসায় চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে এই দাবি জানানো হয়েছে সংসদে।

অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজের জন্য বিষয়টি বিড়ম্বনা মনে করেন কি না, সে এক বড় প্রশ্ন। বিরোধী দল যে দাবি করেছে, সে প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলতে পারেন, তিনি পদত্যাগ করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? না, হয় না। তবুও দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের দায়িত্ব নিতে হয়। নয়তো আমরা কেন দেখি যে, বিমান দুর্ঘটনার পর কোনো এক দেশের বিমানমন্ত্রী পদত্যাগ করছেন? বিমানটি তিনি চালাচ্ছিলেন না, তবুও দায় নিয়ে সরে দাঁড়ান। এটা সভ্য দেশের রীতি। এইতো সম্প্রতি সমালোচনার মুখে নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন।

দেড় বছর পরে এসে প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও আমরা দেখি সারাদেশের সরকারি হাসপাতালের ৫২ শতাংশে আইসিইউ নেই। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।

আমাদের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, একজন মন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সচিব প্রধান হিসাব রক্ষক। তাই মন্ত্রণালয়ের যেকোনো সাফল্য বা ব্যর্থতা দিন শেষে মন্ত্রীকেই নিতে হয়।

অবহেলাও অপরাধ। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলো তা বারবার প্রমাণ করেছে। কিন্তু করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এ বদনাম থেকে নিজেদের বের করে আনতে পেরেছেন ব্যাপকভাবে।

করোনাকালে এসে আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে। বলতে গেলে একদম শূন্য প্রস্তুতি নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতির কথা বলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেমেছিলাম আমরা। মানুষ প্রথম দিককার সব অসংলগ্ন অবস্থাকে মেনেও নিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থ বরাদ্দ করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এখন অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন যেকোনো উৎস থেকে যেকোনো মূল্যে টিকা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে।

কিন্তু দেড় বছর পরে এসে প্রধানমন্ত্রীর অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও আমরা দেখি সারাদেশের সরকারি হাসপাতালের ৫২ শতাংশে আইসিইউ নেই। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। অথচ দুই বিভাগের ১৮ জেলার ১০টিতেই সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই।

গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে বলেন তিনি। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। কিন্তু আজ শুনতে হয় ৩৭ জেলায় অক্সিজেন নেই। অক্সিজেনের অভাবে যে রোগীগুলো সাতক্ষীরায় আর বগুড়ায় মারা গেল তাদের দায়িত্ব কে নেবে?

শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি, এর কোনো বিকল্প নেই। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেশন দরকার হয়। কিন্তু আজ সেটারই সঙ্কট।

আমরা জানতাম, মারাত্মক উদাসীনতা চিকিৎসা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কিন্তু এমন জাতীয় পরিস্থিতিতেও এর ব্যতিক্রম হবে না? নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষিত হওয়া বড় গাফিলতি এবং একই সাথে চরম অদক্ষতা।

কি এক করুণ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি! আইসিইউ সুবিধা না থাকায় হাসপাতালগুলোতে জটিল করোনা রোগীদের ভর্তি করানো যাচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি কারও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বা আইসিইউ প্রয়োজন হলে আশপাশের অন্য জেলার হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

টাকার তো অভাব ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও করোনায় মারা যাওয়া চিকিৎসকদের পরিবারগুলো কেন এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পেল না, সেটা দেখাও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব বলেই মনে করি।

জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা থাকলে মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো। এখন ঘুম থেকে উঠে মানুষকে জানতে হয় কোন জেলায় কত রোগী মারা গেছে। এই পরিস্থিতি হওয়ার কথা ছিল না এবং এমন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে—এই এক বছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী কাজ করেছে?

টাকার তো অভাব ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও করোনায় মারা যাওয়া চিকিৎসকদের পরিবারগুলো কেন এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পেল না, সেটা দেখাও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব বলেই মনে করি। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলেই মনে হচ্ছে। দেড় বছরে মানুষকে মাস্কটুকু পরাতে না পারা অবশ্যই জাতীয় ব্যর্থতা। শুধু এটুকু করা গেলে অনেক জীবন হয়তো রক্ষা পেত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড বলছে, কোনো দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে তখনই মনে হবে যখন সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে। বাংলাদেশে এখন এই হার ২০ শতাংশের উপরে। আমরা একটি দিনের জন্যও শূন্য মৃত্যু বা শূন্য সংক্রমণের দিন পাইনি। তাহলে কেন করোনা জয়ের উচ্ছ্বাস করেছিলাম সেটা এক বড় জিজ্ঞাসা।

সব দেশ যখন লকডাউন নির্ভর ছিল, আমরা তখন তা করিনি। এখন লকডাউন থেকে বেরিয়ে এসে সবাই টিকা নির্ভর হচ্ছে, আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে। জীবিকা বাঁচাতে হলে জীবন বাঁচাতে হবে। আশার কথা এই যে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন টিকা আসবেই।

মনে আছে, করোনাভাইরাসের আক্রমণের একদম শুরুর দিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি জাতীয় কমিটির সভাপতি হলেও কোথায় কি হচ্ছে তিনি জানেন না। আশা করছি এখন সে পরিস্থিতি নেই তার জন্য। তিনি দায়িত্ব নিয়েই নড়চড়ে বসবেন।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি