বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচি অত্যন্ত সমৃদ্ধ, মর্যাদাপূর্ণ। বছরে ৩০-৪০ লক্ষ শিশুদের ৮০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ক্রমাগতভাবে অর্জন করে আসা স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছে টিকা হিরোর বিশ্ব মুকুট। সেই দেশ করোনা টিকাদানে সাফল্য পাবে, তার টিকাদান কর্মসূচি নিজের সক্ষমতার পরীক্ষায় উতরে যাবে সেটাই কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু এ পর্যন্ত পরিচালিত করোনা টিকাদানে, সেটা সর্বতোভাবে সফল হয়েছে তা বলা যাবে না।

গত চল্লিশ বছর ধরে অনুসৃত খানাভিত্তিক নিবন্ধন পরিহার করে, দেশের সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন টিকাদান কর্মীদের বাদ দিয়ে টিকাদান এবং সারা উপজেলার জন্য মাত্র একটি করে কেন্দ্রের মাধ্যমে টিকাদান এবং গ্রামের নিরক্ষর বয়স্ক মানুষদের যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ করতে না পারার ফলে প্রথম পর্যায়ের টিকাদানে গ্রামের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ টিকা বঞ্চিত হয়েছে।

অবশেষে গ্রামের দুর্ভাগা মানুষদের বাধাগুলো দূর করতে সরকার নিবন্ধন সহজীকরণ, কেন্দ্র বৃদ্ধিকরণ এবং পরীক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গ্রামের উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে।

আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে, উদ্দিষ্ট টিকা গ্রহীতাদের তালিকা তৈরি না করা। এর ফলে দুটো সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, নির্দিষ্ট দিনে কতজন টিকা নিতে আসছেন, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা।

গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার ব্যাপক আগ্রহ। কিন্তু কয়েকটি বড় বাধা এখনো রয়ে যাওয়ায় টিকাদানে বেশ কিছু বিশৃঙ্খল পরিবেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

প্রথমত, জাতীয় পর্যায়ে প্রস্তুতিহীনতা ও সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। আরম্ভের তারিখ, উদ্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আসছে, যা জনসাধারণ এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে টিকা প্রদান অণুপরিকল্পনায় বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি তৈরি করছে।

আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে, উদ্দিষ্ট টিকা গ্রহীতাদের তালিকা তৈরি না করা। এর ফলে দুটো সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত, নির্দিষ্ট দিনে কতজন টিকা নিতে আসছেন, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা।

আমরা এবারের টিকা প্রদানের প্রথম দিন দেখেছি যে, কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে অনেকে টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন। কোনো কোনো কেন্দ্রে টিকার ২/৩ গুণ লোক আসায়, বিপুলসংখ্যক লোক ফিরে গেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, কোনো লোকালয়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট হার (৮০%) অর্জন করা গেল কি না, তা বোঝা কঠিন হবে।

এমনকি কোনো লোকালয়ের জনগণ পুরোপুরি বাদ গেল কি না তাও অনুধাবন করা যাবে না। এই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য প্রথমত জাতীয় পর্যায়ে, প্রস্তুতি আরও বেশি করে নেওয়া গেলে তা করোনার টিকা সফলভাবে প্রদানে এবং শেষ পর্যন্ত সার্থকভাবে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, টিকা দেওয়ার পূর্বেই সব লোকালয়ে খানাভিত্তিক জরিপ করে পূর্বেই তালিকা তৈরি করা। প্রত্যেক টিকাদান দিবসের আগে, সরকারের নির্দেশ মতো বয়স বা অন্যান্য বিবেচনায় নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিকে আসার জন্য আসতে বলা গেলে, টিকা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তি আসবে এবং টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে না।

টিকা সার্টিফিকেট বিদেশ গমনসহ নানা কাজে প্রয়োজন হবে বলে, যেকোনো এলাকায় যেকোনো ভাবে টিকা দেওয়া হোক, তারা যেন যথাযথভাবে প্রত্যয়ন পত্র পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

তালিকাভুক্তদের কেউ টিকা নিতে না আসলে, তা সহজেই বোঝা যাবে এবং তাকে ঐ দিনই আসার জন্য তাগিদ দেওয়া যেতে পারে এবং শতভাগ বা কাছাকাছি হার প্রত্যেক টিকা সেশনে অর্জন করা যেতে পারে। প্রত্যেক লোকালয়ে নিবন্ধন করা হলে, বাংলাদেশের কোনো লোকালয় বাদ না থাকায় জাতিগতভাবে আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।  বাংলাদেশে ১৫ হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, তার চারদিকে ১২শ থেকে দুই হাজার খানা আছে এবং ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার লোক বসবাস করেন।

স্বাস্থ্য সহকারী, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), পরিবার কল্যাণ সহকারী, ব্র্যাক কর্মীসহ স্বেচ্ছাসেবকরা ৫/৬ জন ৭/৮ দিনের মধ্যে শেষ করতে পারে। সকল বয়সের জনগণের তালিকা একবারে করা গেলে, ভবিষ্যতে যখন ১৩ বছর বয়সী এবং ২ বছর ঊর্ধ্ব সকলকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে।

টিকা সার্টিফিকেট বিদেশ গমনসহ নানা কাজে প্রয়োজন হবে বলে, যেকোনো এলাকায় যেকোনো ভাবে টিকা দেওয়া হোক, তারা যেন যথাযথভাবে প্রত্যয়ন পত্র পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ইপিআই কর্মসূচিতে যে গর্বের ভাগীদার সেটাকে যেন সমুন্নত রাখতে পারি, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন এবং করোনা টিকাদানে গণজাগরণ সৃষ্টি হবে এই প্রত্যাশা রইলো। 

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক