‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ।’—সেই ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে এরকম একটা লেখা পড়েছিলাম। যদিও তখন মদিনা বহুত দূর, আমাদের নিজেদের পাড়াটাই ঠিকমতো চেনা হয়ে ওঠেনি। তবে চিনতে পেরেছিলাম ‘ঈদ’ কী। ঈদ মানে নতুন শার্ট, প্যান্ট, জুতা। বোনদের হাতে মেহেদি, চুলের ফিতা, টিপ, লিপিস্টিক। বাজারের ভিড়ে গরম মসলার মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধ। আর ঈদ মানে হলো পিতৃদেব ও মাতৃদেবের সাংবাৎসরিক গৃহদাহ এবং মান-অভিমানের পালা। তার মধ্যে চৈত্র-বৈশাখের গরম এসে বইয়ে দিত আগুনের হলকা। রিকশার টুংটাংওয়ালা আমাদের ওই মফস্বলে ঈদ আসত টুংটাং শব্দ করেই। শেষ রাত পর্যন্ত শোনা যেত বাড়ি ফেরা মানুষের পায়ের শব্দ। 

বড় হতে হতে দেখলাম ঈদ আমাকে আর তেমন করে টানছে না। আঁকড়ে ধরেছে ঈদের দিনে ঘরবন্দি থাকার অভ্যাস। সেই কৈশোরে একদিন হাতে এসে পড়েছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। সম্ভবত কোনো বিনোদন পত্রিকার সংখ্যা। কীভাবে, কোন সূত্রে এসে পড়েছিল, ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে, একটি গল্প পড়েছিলাম। খানিকটা শরীরী আবেগ ঘেঁষা। অতএব চকচকে চোখ মেলে আনন্দিত চিত্তে সেটিতে ডুবে থাকা গেল। 

তখন জেনেছিলাম, ঈদ সংখ্যা হলো লেখালেখির বিরাট এক বাজার; ওখানে অনেক অনেক গলি। আছে খাবার ঘর, বিশ্রামের ঘর, সিনেমা হল, থিয়েটার, আর্ট গ্যালারি—সব একাকার। অর্থাৎ ঈদ সংখ্যার একেক গলির ভেতর ঢুকে পড়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা, ভ্রমণ কাহিনি, সংগীত, সিনেমা, রান্নাবান্না, খাবার দাবার।

আমাদের মতো মফস্বলের লোকের জন্য এই আয়োজন নিঃসন্দেহে হৃদয় মনোহর। সত্যিকার অর্থে, ঈদ সংখ্যাগুলো মনোহারী দোকানও বটে! বেছে নিন, যা কিছু পছন্দ আপনার। একটি দুটি লেখা পড়ুন, বাকিটা ফেলে রাখুন। অন্য কোনো সময় চোখ বুলিয়ে নিন।

ততদিনে আমরা ঢুকে পড়েছি সাহিত্যের সরু গলিতে। সদর রাস্তার নিশানাও জানি না। মনের দরজা কেবল আলতো করে খুলতে শুরু করেছে। ম্যাগাজিন জাতীয় বই পড়ার প্রতি পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও কিঞ্চিৎ চোখ কুঁচকানোর ভাব ছিল বাড়ির কর্তাকত্রীদের। কারণ ওই একটিই—শৃঙ্গার রস যদি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে কোথাও! অভিভাবকদের এই সন্দেহকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে আজ বলতেই পারি, আবরণহীন অংশটুকুর দিকেই আমাদের চোখ পড়ত বেশি; যেমন করে আমার চোখে পড়েছিল প্রাপ্তবয়স্কের উপযোগী ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত গল্পে। পত্রিকাওয়ালারাও কম যান না, এমন দুই একটা বাক্যের ওপর জোর দিতেন যে, না পড়ে আসর ছেড়ে ওঠা দায়। আর তাই পত্রিকা, সাময়িকীর দিকে ঝুঁকে পড়েছিলাম। 

নব্বই দশকে বড় একটা পরিবর্তন এলো। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ল। কমে গেল বিচিত্রা কিংবা রোববারের প্রভাব। চোখের সামনে উঠে এলো রঙচঙে প্রচ্ছদের ঝকঝকে ছাপা ঈদ সংখ্যা। বাংলাদেশে তখন তারুণ্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছে জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ।

ঈদ সংখ্যা হয়ে উঠেছিল ঈদ বিষয়ক আকর্ষণের বড় একটা দিক। যে ম্যাগাজিনগুলো সাধারণত পড়তাম, সেগুলোরই ঈদ সংখ্যা জোগাড় করে পড়ে ফেলতাম। মনোযোগের সঙ্গে পড়তাম কবিতা, ছোটগল্প, ফিচার। উপন্যাস পড়তাম সময় নিয়ে, ধীরে সুস্থে। বাদ বাকি সব লেখা পড়ে ফেলতাম এক নিশ্বাসে। এমনও হয়েছে দশ বছর আগের কোনো সংখ্যা হাতে এসে পড়েছে দশ বছর পর। তার মানে, সংখ্যাগুলোর ‘আর্কাইভ ভ্যালু’ ছিল! অনেকে সেসব জমিয়েও রাখতেন। তারই সূত্র ধরে হাতে এসেছিল বিচিত্রা, রোববার। 

নব্বই দশকে বড় একটা পরিবর্তন এলো। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ল। কমে গেল বিচিত্রা কিংবা রোববারের প্রভাব। চোখের সামনে উঠে এলো রঙচঙে প্রচ্ছদের ঝকঝকে ছাপা ঈদ সংখ্যা। বাংলাদেশে তখন তারুণ্যের দীপ্তি নিয়ে এসেছে জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ।

নব্বইয়ের শেষ ভাগে এসেছে প্রথম আলো। সাপ্তাহিক পত্রিকার চাহিদা নেমে গিয়েছিল একেবারে নিচের দিকে। বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাজারে এসেছিল সাপ্তাহিক ২০০০। কিছু দিন দুর্দান্ত তৎপরতার সঙ্গে কাজ করেছে সাপ্তাহিক চলতিপত্র। রঙচঙে প্রচ্ছদ দিয়ে আর অলংকরণ দিয়ে প্রভাব ফেলেছিল অন্যদিন পত্রিকা। তিনটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যাই নজর কেড়েছিল। 

এক সময় সাপ্তাহিক পত্রিকার পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকাগুলোও ব্যস্ত হয়ে পড়ল ঈদ সংখ্যার আয়োজনে। দেখতে পেলাম, ঈদ সংখ্যার বাজারে একটা প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। কোন পত্রিকা কত বেশি উপন্যাস ছাপবে, কত বেশি পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন প্রকাশ করবে, সেসব নিয়ে হাই-জাম্প, লংজাম্প খেলা শুরু হয়ে গেছে।

শোনা যায়, অসমাপ্ত উপন্যাস এবং বড় গল্পকে উপন্যাস বলে ছেপেছে অনেক পত্রিকা। কোনো কোনো উপন্যাস পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, লেখাটি হয়তো কোনো উপন্যাসের খসড়া। কারো কারো উপন্যাসের পরিচ্ছেদ নির্মমভাবে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। তবে আশির দশকে কোনো কোনো উপন্যাস ঈদ সংখ্যা থেকেই শিল্প সাহিত্যের পাড়া কাঁপিয়ে তুলত। পরবর্তীকালে সেসব উপন্যাস পৌঁছে গিয়েছেন সিরিয়াস সাহিত্য ভোক্তাদের পাতে।

বিখ্যাত কিছু উপন্যাসের নাম আমরা নিতেই পারি। সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ছাপা হয়েছিল ১৯৭৯ সালের বিচিত্রায়। একই পত্রিকায় ১৯৮০ সালে ছাপা হয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর ‘চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর’। ১৯৮১ সালে পাওয়া গেল শওকত আলীর উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। 

ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, দেশ রূপান্তর, কালের কণ্ঠ, বণিক বার্তার মতো বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো প্রতি বছর হাজির করছে ঈদ সংখ্যা। এক সময় সাড়া ফেলেছিল ডেসটিনি, আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। প্রশ্ন হলো, ঈদ সংখ্যার সাংস্কৃতিক প্রভাব কেমন?

আশির দশকে ঈদ আয়োজনেই পাওয়া গিয়েছিল শওকত আলীর ‘উত্তরের খেপ’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘মহাপুরুষ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘অপরাহ্ণ’, ‘১৯৭১’, ‘সৌরভ’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘রূপনগর’, ‘ভূমিপুত্র’, ‘পরাধীনতা’। আনু মুহাম্মদের অনুবাদে বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল ওরিয়ানা ফালাচির বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাত বাড়িয়ে দাও’। নব্বই দশকের শেষ দিকে ঈদ সংখ্যার সূত্রে পাওয়া গিয়েছে হুমায়ুন আজাদের ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’, হুমায়ূন আহমেদের ‘রূপার পালঙ্ক’, আনিসুল হকের ‘ফাঁদ’। ঈদের বাজারেই উপন্যাসগুলো শোরগোল তুলেছিল। 

ঈদ সংখ্যায় প্রবন্ধের আয়োজনও ছিল চকমপ্রদ। ১৯৮২ সালে রোববারের বিষয় হিসেবে ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী থেকে শুরু করে ফুটবল ও কবিতা, দেহভাষা থেকে শুরু করে অভিনেত্রী লিজ টেলর। এর পরের বছর, ১৯৮৩ সালে প্রবন্ধের বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদক্ষেত্র ও অধিকার।

বিশেষ নিবন্ধের বিষয় তালিকায় এসেছে ক্ষমতা, আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি, খাদ্য পরিস্থিতি এবং দু’হাজার এক সালের সম্ভাব্য পৃথিবী! খানিকটা অবাকই হতে হয় এই ভেবে যে, বামপন্থী রাজনীতি, ওষুধ নীতি, মাও সে তুং, ঢাকার ফুটবল ও ক্রিকেটের ইতিহাসের মতো প্রায় গবেষণাধর্মী প্রবন্ধও ছাপা হয়েছে ঈদ সংখ্যায়।
 
বিষয়ের গুণেই পাঠক টানতে পেরেছিল ফিচারগুলো। যেমন ১৯৮৪ সালে রোববারে ছাপা হয়েছে বিশ্বসেরা দশ জন চলচ্চিত্রকারের সচিত্র বিবরণ। সেই বিবরণে আছেন ফেদেরিকো ফেল্লিনি, আকিরা কুরোসাওয়া, লুই বুনুয়েল। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে সেরা তারকাদের কাজ ও জীবন নির্ভর ফিচার। বিকিনি আর স্তনরেখা-সমেত লাবণ্য ও যৌনতা ছড়িয়েছেন অড্রি হেপবার্ন, সোফিয়া লরেন, মেরিলিন মনরো; রঙিন হয়ে উঠেছিল ঈদ সংখ্যার সাদা-কালো পৃষ্ঠা।

ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদগুলো উপহার দিত তাকিয়ে দেখার মতো আনন্দ। বিচিত্রার চার রঙা প্রচ্ছদগুলোর কোনো কোনোটিতে ব্যবহৃত হয়েছে কেবলই ছবি; কোনো ঝকমারি নেই, শান্ত ও স্নিগ্ধ নারীর মুখাবয়ব। আঁকাআঁকি বিষয়ে অবশ্য-উল্লেখ্য প্রসঙ্গ হলো রনবীর কার্টুন। টোকাই, বস্তিবাসী, মধ্যবিত্ত এবং ঈদ-বাজারের টানাটানি নিয়ে আঁকা তার কার্টুনগুলো পাঠককে দারুণভাবে ঘা দিয়েছে।
একটি সংখ্যায় টোকাইয়ের ছবির পাশে লেখা ‘টোকাই সমিতি’; তার পাশে লেখা, ‘আপনার বাড়ীর পাশের অন্তত একজন টোকাইকে আপনার শিশুর সাথে ঈদের কাপড় উপহার দিন।’ আরেকটি কার্টুনে টোকাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ‘ঈদ কেমন করলি?’ টোকাই জবাব দিয়েছে, ‘তোমাগো মতন।’ টোকাইয়ের উত্তর বহুমুখী ইঙ্গিতময়।

আশি-নব্বই দশকের সম্ভাবনাময় তরুণ কবি ও লেখকেরা এ কালের নাম-ডাকওয়ালা কবি ও লেখক। তখনকার সাংস্কৃতিক কারখানায় যারা ছিলেন নবাগত, তারা আজ খ্যাতিমান তারকা। আশির দশকের এক ঈদ সংখ্যার নিবন্ধের বিষয় ছিল, ‘নতুন তারকা নতুন সম্ভাবনা।’ মফস্বলের ধুলাবালিতে হাঁটতে ফিরতে আমরা এদের লেখা পড়তাম, ছবি দেখতাম।

শিল্প-সংস্কৃতির ‘তারায় তারায় খচিত আকাশ’ যেন মাটিতে নেমে এলো। সংস্কৃতি কারখানার হাল-হকিকত সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ত। শোনা যেত, সংস্কৃতির ‘কেন্দ্র’ ও ‘প্রান্ত’র স্বতন্ত্র স্বর। পত্রিকার ঈদ সংখ্যাগুলো ছিল বাংলাদেশি/ ঢাকাই সংস্কৃতির শক্ত এক অভিজাত প্রতিনিধি।

১৯৪৮ সালে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল বেগম পত্রিকা। এখনো পত্রিকা তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ কালে ঈদ সংখ্যা হয়ে উঠেছে মুদ্রণ গণমাধ্যমের একটি সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কৃত্য।

অবশ্য বছর জুড়েই পত্রিকাগুলো তাদের ফিচার পাতায় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে যেত। কিন্তু ঈদের আয়োজন ছিল বিস্তৃত ও বিচিত্র। অনেকের মাথায়ই কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। ঈদ সংখ্যার সাংস্কৃতিক দাপট কি আগের মতো আছে? লোকেরা পড়ে? একালের পরিস্থিতি কেমন? প্রশ্নগুলোতে লুকিয়ে থাকে পাঠকের অতীত ও বর্তমানের তুলনামূলক হিসেব।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজে ঈদ সংখ্যার আয়োজন নিয়ে এখন আর মোটেও উত্তেজিত নই। কখনো কখনো কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যা হাতে নিয়ে মনে হয়েছে বিজ্ঞাপন-ব্যাকুল, চার রঙে রাঙনো সুমুদ্রিত আবর্জনা মাত্র। সন্দেহ জাগে, আঠারো পেরুনো তরুণেরা আমাদের ‘উত্তীর্ণ কৈশোর’-এর মতো করেই ঈদ সংখ্যার দিকে ধাবিত হন কি না। কেননা মুদ্রিত পত্রিকার প্রতি পাঠকের আগ্রহ কমেছে।

ডিজিটাল ডিভাইসে বিচিত্র বিষয় পড়ার সুযোগ নিচ্ছে নবীন পাঠক। মুদ্রণ সংস্কৃতির ‘ঈদ সংখ্যা’ নামক পাঠ্য বস্তুর কদর কমবে বলেই অনুমান করা যায়।

সাম্প্রতিক কালে ঈদ আয়োজনে শামিল হয়েছে অনলাইন প্রকাশনাগুলো। কিন্তু সেখান থেকে দীর্ঘ আয়তনের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ কয়জন পাঠক পড়েন, কে জানে! পত্রিকা পক্ষই এসব প্রশ্নের সত্যিকার জবাব ও পর্যবেক্ষণ জানাতে পারবেন। এটুকু বিবরণ পড়ে মনে হতে পারে, ঈদ সংখ্যা বুঝি ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাও নয়। কারণ ঈদ সংখ্যার আয়োজন আগের চেয়েও জমজমাট।

ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, দেশ রূপান্তর, কালের কণ্ঠ, বণিক বার্তার মতো বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলো প্রতি বছর হাজির করছে ঈদ সংখ্যা। এক সময় সাড়া ফেলেছিল ডেসটিনি, আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। প্রশ্ন হলো, ঈদ সংখ্যার সাংস্কৃতিক প্রভাব কেমন? আমার অনুমান, ব্যক্তিক পরিগ্রহণ বিষয়ক তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করবে এর জবাব।

অনেকেই আছেন যারা বড় হয়েছেন ঈদ সংখ্যা সংগ্রহ ও পড়ার সংস্কৃতির ভেতর। কেউ কেউ আছেন, ঈদ বিষয়ক এই সৃষ্টিশীল ও নান্দনিক আয়োজনের সঙ্গে কোনো আন্তরিক সম্পর্ক বোধ করেননি। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচনা হতে পারে এই পত্রিকা কিংবা সাময়িক পত্রের ঈদ সংখ্যা বাঙালির জন্য এক সাংস্কৃতিক অভ্যাস। 

এই অভ্যাসের সূচনা ঘটেছিল বিশ শতকের প্রথম দশকে। সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকায় প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছিল ঈদ উৎসব বিষয়ক লেখা। সাহিত্যিকভাবে ঈদ উদযাপিত হতে পারে, এই ধারণার উৎস সম্ভবত এই পত্রিকা। যদিও আজকের অর্থে এ উদ্যোগকে ঈদ সংখ্যা হিসেবে অভিহিত করা যায় না।

ঐতিহাসিক বৃত্তান্তে উঁকি দিলে দেখা যাবে, ‘ঈদ সংখ্যা’ ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের অংশ। উৎসবের আমেজে ঈদ কেন্দ্রিক প্রকাশনা গড়ে তুলেছিল মুসলমানের সাংস্কৃতিক পরিচয়। আজ থেকে ৭৪ বছর আগে, ১৯৪৮ সালে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল বেগম পত্রিকা। এখনো পত্রিকা তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ কালে ঈদ সংখ্যা হয়ে উঠেছে মুদ্রণ গণমাধ্যমের একটি সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কৃত্য। ধর্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষ এই কৃত্যটি সৃষ্টি করতে চায় ভাবগত আবেদন। তার সঙ্গে মিশে থাকে ঢাকাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক ও নন্দনতাত্ত্বিক রাজনীতি।

এসবের সীমানা ডিঙিয়ে আমি যেতে চাই, মৃদু নস্টালজিয়ায়; আশির দশকের সেই পর্বে যখন কাঁধের ওপর শ্বাস ফেলছে সামরিক শাসন, কিন্তু কবি, লেখক ও শিল্পীরা নেমে গেছেন নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের পক্ষে। ভাঙাচোরা সময়ের পাটাতনে তখন তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশি সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, চিত্রকলা ইত্যাদি।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ঈদ সংখ্যার বিনোদনের ভেতরই পত্রিকাগুলো জুড়ে দিয়েছিল সমাজ বদলের সম্ভাব্য নিশানা। লেখায় আঁকায় আধেয় হিসেবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, বিপ্লব, শ্রমিক শ্রেণি নিশ্চয়ই এমনি-এমনি আসেনি! গূঢ় ইঙ্গিত ছিল কি? হতে পারে। হয়তো তাই ঈদ সংখ্যাগুলো হয়ে উঠতে পেরেছিল মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও খুশির আধার। সেই সময়ে আমরা কোনো দিন ফিরতে পারব না জানি, কিন্তু আমরা কি গড়তেও পারছি! নাকি আবছা কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ? উত্তর যা-ই হোক; তবুও আনন্দ জাগুক বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।

সুমন সাজ্জাদ ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়