ছবি : সংগৃহীত

এক.

গনি মিয়া। ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন। মাঝারি মানের একটি পোস্টে। তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা সাত, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও বৃদ্ধ বাবা-মা। খরচ কুলাতে পারেন না। তাই পরিবারকে রেখেছেন মফস্বলের এক শহরে। 

প্রতিবার রোজা আসলেই তিনি শুরু করেন বাড়তি খরচ কাটাকাটি। তেমন একটা ইফতার করেন না। সেহেরিও সেভাবে করেন না। শুধু পানি আর একটা খেজুর খেয়ে তারাবি পড়েন। তারপর একেবারে ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েন। 

সেহেরির সময়ে তিনি শুধু পানি খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রিকশায় চড়েন না তিনি। বাসেও উঠেন না। অথচ অফিস থেকে বাসার দূরত্ব অনেক। তার কোনো ছাতা নেই। রোদে পুড়ে ঘামে-ঘেমে হেঁটে হেঁটে অফিস যান। আবার অফিস থেকে বাসা।   

দুই.

‘মধ্যবিত্ত’ নামে একটি শব্দ আছে। না উপরে, আবার নিচেও না। মাঝামাঝি এদের অবস্থান। এ জন্য নামটি ‘মধ্যবিত্ত’। এই মধ্যবিত্তেরও আবার একটি ভাগ আছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই ভাই অথবা দুই বোন, অথবা এক ভাই, এক বোন। একজন মধ্যবিত্ত। অন্যজন নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই স্তরের মানুষই বড় অসহায়। তারা মুখ ফুটে পারে না কিছু বলতে। চরম দুর্দিনেও তারা মুখ খুলতে নারাজ। বলতে নারাজ আমি বা আমরা ভালো নেই। নিদারুণ কষ্টে আছি। বরং নিজেকে, নিজেদের লুকিয়ে রাখার প্রবণতাটাই বেশি। পাছে না অন্যে জেনে যায়। কী লজ্জার হবে সেটা!

প্রয়াত লেখক, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানোর চেয়ে ফকির হয়ে জন্মানো ভালো। ফকিরদের অভিনয় করতে হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তদের প্রতিনিয়ত সুখী থাকার অভিনয় করতে হয়।’

মধ্যবিত্তের আবার সংজ্ঞা কি? মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মতো। তিনি বলেছিলেন—‘যে গল্প শেষ হইয়াও হয় না শেষ, তাহাই ছোট গল্প।’ তেমনি মধ্যবিত্তের সব ইচ্ছা আহ্লাদ পূরণ হয়েও ফুরায় না। এটা কিনলে ওটা হয় না। কিছু পেলো তো কিছু ছাড় দিলো। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মধ্যবিত্তের সংসারে কাউকে না কাউকে অনেকটা ছাড় দিতে হয়। মধ্যবিত্ত জীবন আসলে অনেকটা ‘শাঁখের করাত’। দুদিকেই কাটে। সবকিছু রক্ষা করে বা নিয়ম মেনে চলার একমাত্র দায়িত্ব শুধু এই মধ্যবিত্তদের। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো হাসিমুখে মেনে নেওয়াটাই হয়তো মধ্যবিত্ত জীবন।

তিন.

তেল, চিনি, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিসিবির লাইনে মানুষের লাইনও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেলেও অনেককে ফিরে আসতে হচ্ছে খালি হাতে। ‘ভালো’ পোশাকের মধ্যবিত্তরাও গরিবদের সেই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, টিসিবির একটা ট্রাকের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছেন একদল মানুষ। শারীরিক ও মানসিকভাবে কুণ্ঠিত কয়েকজন (ভালো পোশাক পরিহিত) সেই দৌড়ে অবধারিতভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক নারী একটা পণ্যশূন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে ঝুলে পড়ে মিনতি জানাচ্ছেন চাল, তেল কিংবা অন্য কোনো খাদ্যপণ্যের জন্য।

অন্য একদিন। টিসিবির ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের দীর্ঘ লাইন দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষকে দেখলাম অসহায় চোখে মানুষের দীর্ঘ লাইনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—কী দেখছেন?
একটু যেন লজ্জা পেলেন আমার কথা শুনে। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আমি যদি লাইনে দাঁড়াই ওরা কি আমাকে সহায়তা দেবে?’

লোকটির পরনে ভদ্র পোশাক। আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারও সহায়তা প্রয়োজন? দেখে তো মনে হচ্ছে না।

চোখে-মুখে সীমাহীন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘আমার এই লেবাসটা অনেক যন্ত্রণার হয়ে উঠেছে। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছি না যে আমি, আমার পরিবার দারুণ আর্থিক কষ্টে আছি। লেবাস বদলে যে পথে নামব, তা-ও তো সম্ভব না! উচ্চবিত্তের দারুণ আনন্দ। কেউ কেউ হাত খুলে সাহায্য দিচ্ছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ কোনো সংকোচ ছাড়াই সেই সাহায্য গ্রহণ করছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষেরা পড়েছি চরম বিপাকে। না পারছি হাত পাততে, না পারছি কাউকে কিছু বোঝাতে।’

চার.

পঞ্চাশ দশকে মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ‘নাগরিক’। এই সিনেমায় তিনি স্বাধীনতা উত্তর শহর কলকাতার সমাজে ভাঙনের চিত্র তুলে এনেছেন শিল্পীর সংবেদনশীল মন দিয়ে। ভাঙনের কেন্দ্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। লেখাপড়া জানা মধ্যশ্রেণির প্রতিনিধি পরিবারটি। পরিবারের প্রধান চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। স্ত্রী, ছেলে- মেয়ে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। অসুখের খরচ মেটাতে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। পেনশনের আয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে উঠে আসতে হয়েছে কলকাতার সস্তা ভাড়ার ঘিঞ্জি একটা পাড়ায়, ছোট পুরনো একটা বাড়িতে। পরিবারের কন্যাটির ‘বয়স’ হয়ে গেলেও বিয়ে হয়নি। বয়সের কারণে পাত্রপক্ষ তাকে পছন্দ করে না। 

ছেলেটি লেখাপড়া শেষ করে চাকরিপ্রত্যাশী। ইন্টারভিউ দিয়ে এসে ভীষণ আশাবাদী, এক মাসের মধ্যেই চাকরিটা হয়ে যাবে, ভাগ্য বদলে যাবে। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে। পুরনো ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটা পুরনো ক্যালেন্ডার। একটা মাঠ পেরিয়ে একটা লাল টালির বাড়ির ছবি। ছেলেটা স্বপ্ন দেখে, চাকরি হলে তার প্রেমিকাকে বিয়ে করবে এবং এ রকম একটা বাড়িতে সবাই মিলে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যায়। হয়ে যাওয়া চাকরিটা তার হয় না। জীবন থেকে অনেকগুলো ‘এক মাস’ হারিয়ে গেলেও চাকরি আর হয় না।

ঋত্বিক একই সঙ্গে পাঁড় বাস্তববাদী ও আশাবাদী শিল্পী। তাই তিনি দূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন সবকিছু পাল্টে যাবে—এমন আশা করেন। কিন্তু বর্তমানের নিরেট বাস্তবতার প্রতিই তার মনোযোগ। ফলে ভাঙনের কালে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার কীভাবে ফুটপাতে সর্বহারাদের কাতারে নেমে যায়, সেই চিত্রই তুলে ধরেন।

পাঁচ.

মধ্যবিত্ত জীবনে আনন্দ ভীষণ কম। তাদের জীবনে আনন্দের উপলক্ষ খুব একটা আসে না। সে কারণে ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবগুলোই তাদের জীবনে প্রধান উৎস। যেকোনো আনন্দ উৎসবে সাথে নতুন পোশাকের বা কেনাকাটার একটা সম্পর্ক আছে। উৎসবের এই কেনাকাটা মধ্যবিত্তের জন্য অনেকটা বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরোর মত হয়ে দাঁড়ায়।

পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকেই হোক কিংবা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই হোক ঈদ আসলে মধ্যবিত্ত মানুষরা মার্কেটে ভিড় জমায়। বছরের এই সময়টাতেই মার্কেটে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে। হয়ত পছন্দের জিনিসে একটু হাত বোলান, একটু স্পর্শ করা সবই ঈদকে সামনে রেখে কিছু সুন্দর কল্পনা। বাস্তবতার তাগিদে হয়ত অনেকের এই কল্পনাটুকু বাস্তবে রূপ নেয় না। ঘুরে-ফিরে কিছুটা আহাজারি। সেই পুরানো স্বপ্নে ফিরে যাওয়া—‘এইবার হয়নি, আগামীবার হবে’ সন্তানের কান্নাভেজা চোখ, স্ত্রীর অভিমানী হাসি, একজন বাবার পরাজিত চেহারা, একজন স্বামীর হতাশার দৃষ্টি ইত্যাদিই হয়তো মধ্যবিত্তের ঈদ আনন্দ, মধ্যবিত্তের ঈদ বাজার।

ছয়.

ঈদে ঐক্য আসে না; অনৈক্যটাই উৎকট হয়ে ওঠে, যতোই সুমধুর স্বরে এ অনৈক্য কাটানোর কথা বলি না কেন, তা একদমই নিষ্ফলা। মধ্যবিত্তের পক্ষে ঈদ এক প্রকার দুশ্চিন্তা। একেবারে বিত্তহীনদের কাছে হতে পারে কিছুটা উপরি পাওনার সুযোগ। আর ওই ধনী-গরিবের পার্থক্যটা এই উৎসবের সময় যেমন স্পষ্ট হয়; দুঃসহ হয়ে চোখে পড়ে; তেমন বোধ হয় বছরের আর কোনো সময় পড়ে না। ভিক্ষুক ও ভিক্ষাদাতার চরম দূরত্বটা তো আছেই, তার বাইরেও সমাজের সর্বস্তরে কেনা-কাটা, পোশাক-আশাক, বিশেষ করে খাবারের আয়োজন-উপভোগে একের সঙ্গে অপরের পার্থক্যটাই দপদপ করে চারিদিকে জ্বলতে থাকে। 

শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে বা পুঁজিবাদের চাপিয়ে দেওয়া এই ফ্যাশন প্যারাডক্সের পুতুলে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার হিসাবও তাই। তারাও চায় উৎসবের আড়ালে দুই পয়সা কামিয়ে নিতে।

সাত. 

মধ্যবিত্তের কষ্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘নীরবে ভিজে যায় চোখের পাতা। কষ্টের আঘাতে বেড়ে যায় বুকের ব্যথা, জানি না এভাবে কাটাতে হবে কত দিন? আমার এই জীবনে কি আসবে না সুখের দিন?’ সুখ তো পরের কথা। এখন প্রয়োজন বেঁচে থাকার সংগ্রামে পারস্পরিক সহযোগিতা। সেখানে ‘মধ্যবিত্তরা’ সমাজের একটি অংশ। 

এবার গনি মিয়ার কথায় আসি। একদা গরিব চাষি হিসেবে গনি মিয়া একজন সুপারস্টার পর্যায়ের তারকা। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, পয়সাকড়ির দিক দিয়ে বেচারার মারাত্মক কাহিল দশা। তার নিজের জমিজমা নেই। তিনি অন্যের জমি চাষবাস করেন। ধানপান যা হয়, তার অর্ধেক যায় মালিকের গোলায়। ভাগের ফসলাদি দিয়ে সংসার চলে না। পরীক্ষার খাতায় এই ভদ্রলোকের কষ্টের কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে করে সেই কত বছর ধরে লক্ষকোটি ছেলেপেলে পাস করে চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গাড়িঘোড়া দাপিয়ে বেড়াল। কিন্তু বইয়ের সেই গণি মিয়ার গরিবি গেলো না। 

সমাজে পরিবর্তন হচ্ছে ঘূর্ণায়মান একটি বিষয়। শুধুই ঘুরছে তো ঘুরছে। চারিদিকে পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন পরিবর্তন। এতোসব পরিবর্তনেও ‘গনি মিয়া’ বাস করে। 

বলা যায়, একটি বই, মলাট আলাদা শুধু। সবই এক, প্রেক্ষাপট আলাদা। প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের মাপকাঠি কে ঠিক করবে? রাষ্ট্রের বিত্ত-বৈভবে যদি বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, তাহলে সমাজের মধ্যে যে ভারসাম্য, তা হারিয়ে যায়। কিন্তু সময় ও বাস্তবতা পালটালেও সেই স্যাটায়ার ‘গণি মিয়া’ একই চরিত্রে মূর্তিমান; তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয় না। হয় তাদের ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়, নাহলে চোখ-মুখ লুকিয়ে একাকী থাকতে হয়।