ষাট দশকের ঈদ। আমার কাছে বড্ড চেনা সময়ের কথা বলে যায়। মায়ের কাছে সেইসব দিনের কথা শুনতে শুনতে আজকাল চোখ বুজলেই স্পষ্ট দৃশ্যপটে ঝকঝকে সময় দেখা হয়ে যায়। আমার কাছে মনে হয় যে, ঈদের সেকাল বা একাল বলে আসলে কিছু নেই।

ঈদের আনন্দ সবসময়ই একই ধারায় বহমান। বিশেষ করে, শৈশবের ঈদ মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় বহন করে। সময়ের পরিবর্তনে উৎসবের আমেজে হয়তো রঙ বদলায়, আনন্দ নয়।

আবার একেক এলাকায় উদযাপনে হয়তো ভিন্ন ভিন্ন ধারা থাকে, মাত্রা থাকে, ধারাবাহিকতা থাকে। ঈদের আনন্দ, সবার জন্য এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে। ঈদের দিন মানেই ঝরঝরে নতুন সময়ের শুরু।

আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা পরিবারগুলোয় সে সময়ে ঈদের কেনাকাটায় তেমন বাহুল্য ছিল না। মায়ের কাছে শুনেছি তখন বাইরে গিয়ে ঈদের বাজার করার মতো তেমন একটা চলও ছিল না। বাড়িতে গজ কাপড় এনে, ঘরের সেলাই মেশিনেই একাধারে ভাইবোন সবার জন্য ফ্রক, পাঞ্জাবি, কামিজ আর ব্লাউজ তৈরি করতেন তারা।

নতুন শাড়ি আনা হলে তাতে সুই সুতায় হাতে নকশা তুলতো সবাই মিলে। তবে সারা বছর যে শাড়ি লাগে তেমন শাড়িই আনা হতো। ছেলেদের জন্য সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামাই ছিল সহজ চল। বাবা পাঞ্জাবি বানাতেন গুলিস্তান মার্কেটের এক সেলাই ঘর থেকে। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে রাদুর স্যান্ডেল জুতা তার খুব পছন্দ ছিল। ঈদের দিন নতুন জুতার বাহানা সব ঘরেই শিশুদের আগ্রহের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বরাবরের মতোই ছিল খুব বেশি।

মধ্যবিত্তের আগামী দু’বছর জুতা আর কেনা হবে না, এই ভাবনায়, শিশুদের পায়ের মাপ থেকে একটু বড় কেনা জুতায় তুলো ভরে চালিয়ে নিতেন। ঈদের দিন বিকেলে মাকে নিয়ে ভেসপা চেপে ঢাকায় ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন বাবা।

যেকোনো উৎসবে তিনি রাতের বেলায় বাড়ির সবাইকে নিয়ে গাড়ি করে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যেতেন। ছোট অথচ সুন্দর সব প্রাপ্তির মাঝে ভরপুর জীবন যাপনের স্মৃতি আমাদের জীবনে বপন করে দিয়ে গেছেন তিনি। 

ঈদের বাজার করার মতো তেমন একটা চলও ছিল না। বাড়িতে গজ কাপড় এনে, ঘরের সেলাই মেশিনেই একাধারে ভাইবোন সবার জন্য ফ্রক, পাঞ্জাবি, কামিজ আর ব্লাউজ তৈরি করতেন তারা।

একাত্তরের আগে আমার মা মাত্র পাঁচ বছরের জন্য বাবার কাছ থেকে সময় পেয়েছিলেন। যেহেতু বাবা খেতে ভালোবাসতেন তাই ঈদের দুপুরে সবাই মিলে খাওয়ার জন্য বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ নিয়ে আসতেন।

ঈদের নামাজ আদায় করার আগে নানু পায়েস খেতে দিতেন, বাটি ভরে। নামাজ শেষে ঈদের সেলামি নেওয়া দেওয়া চলতো। এক টাকা সেলামি পাওয়া মানে সে সময়ে বিশাল ধনী হয়ে যাওয়া। এরপর সারাদিন ধরেই আমাদের পারিবারিক বন্ধুদের আসা যাওয়া চলতো। খাওয়ার পর্ব চলতো সারাদিন জুড়ে।  

কমলাপুর বৌদ্ধমন্দিরের বড় ভান্তে থেকে শুরু করে শাঁখারীপট্টি থেকে আসা মামার বন্ধু গণেশের পরিবার, ঈদের আনন্দে দিন কাটাতো আমাদের বাড়িতে। বাবার চলচ্চিত্রের সহযাত্রী, গণসঙ্গীতের বন্ধু, বিভিন্ন আন্দোলনে দীর্ঘদিনের পথের সাথীরা কেউ না কেউ ঈদের দিন চলে আসতো ঠিক ঠিক।

সেই সময়ে চাকচিক্যের বাহুল্য নয়, একতায় সহজ সাধারণ আনন্দের মাঝেই ঈদের দিন যাপিত হতো। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নয় এমন আত্মীয় স্বজনদের ঈদের দিন বাটি ভরে রান্না করা খাবার পাঠানো হতো। সারা বছরই এমন পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সাহায্যের চল সবসময়ই থাকতো। 

ঈদের একালে বাহ্যিক চাকচিক্য বেড়েছে বহু গুণ। সময়ের গতিধারা বহন করে এনেছে প্রচুর অনুষঙ্গ। আকাশ তরঙ্গ নির্ভর সাংস্কৃতিক চর্চায় সাজগোজ আর আতিথেয়তায় বদল এসেছে অনেক। প্রতি বছরই তাই নতুন আদলে ঈদের চেহারা বদলাতে থাকে।

ঈদের একালে বাহ্যিক চাকচিক্য বেড়েছে বহু গুণ। সময়ের গতিধারা বহন করে এনেছে প্রচুর অনুষঙ্গ। আকাশ তরঙ্গ নির্ভর সাংস্কৃতিক চর্চায় সাজগোজ আর আতিথেয়তায় বদল এসেছে অনেক।

কখনো কোনো সিনেমার নায়িকার শাড়ি ভর করে নারীদের মাঝে, আবার কখনো লাখ টাকার লেহেঙ্গা। অনেকে হালফ্যাশনের কাপড় অলংকার কিনতে দেশের বাইরেও চলে যায় আজকাল। এই সময়ের ঈদ, কেনাকাটা নির্ভর হয়ে গেছে।

আবার দেখা যায়, অনেকে ঈদের দিনে রান্নাবান্না, আত্মীয়স্বজন আপ্যায়নকে ঝামেলা মনে করে সেই সময়ে ছুটি কাটাতে দেশের বাইরে চলে যায়। আয়োজন, উদযাপনে এতশত বদল হওয়ার পরও ঈদের নতুনত্ব সবার জন্যই পৃথক অর্থে হলেও হাসিমাখা সময়ের কথাই বলে চলে এখনো।

আমার মতো শহীদ পরিবারের কাছে যেকোনো উৎসব একাত্তরের আগেই রঙিন ছিল। আমাদের জীবন জুড়ে পূজা, পার্বণ, ঈদ, বিজয় সবদিনই আসে, সাদাকালো হয়ে। সবার আনন্দে নিজেদের শোক চাপা দিয়ে হাসিখুশি থাকার প্রচেষ্টা চলতে থাকে, অবিরত।

ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি ঈদের দিন শুধুমাত্র অতিথি আপ্যায়নের জন্যই ভালোমন্দ রান্না করা হয়। বিশেষ কোনো পদের রান্নার চল আর নেই বললেই চলে। ঘরের সহকারী বা আশেপাশে থাকা দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য উপহার দেওয়ার রীতিটা অবশ্য আজও আছে।

ঈদের দুপুরে সেসব পরিবারের সন্তানদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাবার নিয়মও চালু করা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। সামাজিক দায়িত্বের জন্যই ঈদ পালন করি আমরা। এই একান্ত অতি ব্যক্তিগত বেদনাহত অনুভূতির কথা হয়তো সবাই অন্তঃস্থল থেকে নাও বুঝতে পারে, তাই বলা হয়ে ওঠে না এসব কথা।

আমাদের হৃদয়ের চিরস্থায়ী আঁধার ঘেরা অভাবটুকু সবাই যেন না বুঝতে পারে, ঠিক সেই ভাবেই দিনটা কাটানোর অভ্যাস করে ফেলেছি, আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে। ঈদ আনন্দ বয়ে আনুক সবার চিত্তে। সবাই হেসে উঠুক ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, অর্থের বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে।

শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা