ছবি : সংগৃহীত

সয়াবিন তেলের বাজারে আগুন। দেড় মন ধানেও কেনা সম্ভব হচ্ছে না পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেল নিয়ে এ ধরনের ট্রল চলছে। বৈশাখের মৌসুমে ধানের দাম কম। প্রতি মন বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। তাই ধানের দামের সঙ্গে তেলের বাজারের তুলনা করে অনেকেই মনের কষ্টের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে!

একজন কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সার ও কেরোসিনের বাড়তি দামের মুখে বোরো ফসল ঘরে তুলেছেন। কিন্তু তার তো কষ্টের ফসলের দাম পাওয়ার কথা। উল্টো চালের বাজার চড়া। এরমধ্যে একজন কৃষক যদি মনে করেন একসঙ্গে মাসের বাজেট হিসাব করে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল কিনবেন; তাহলে তাকে দেড় মনের বেশি ধান বিক্রি করতে দিতে হচ্ছে! 

পাঁচ লিটার সয়াবিন যদি ৯৮৫ টাকায় কিনতে হয় তাহলে অন্যান্য পণ্য কিনবেন কীভাবে? তেল খেলে তো পেট চলবে না। শুধু যে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে বিষয়টি তো এমন নয়। যেখানেই হাত দেওয়া হয় সেখানেই তো আগুন! সাবান, পেন্সিল ব্যাটারি, নুডলস থেকে শুরু করে কোন নিত্যপণ্যটির দাম কম? 

কৃষি অর্থনীতি নির্ভর মানুষগুলো এভাবে ধান বিক্রি করে বাড়তি দামে পণ্য কিনে চলবে কতদিন? কৃষক বলে কথা নয়, ভোগ্যপণ্য কিনতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সব শ্রেণির মানুষের বিরাট ছন্দপতন ঘটেছে। বর্তমান বাজার মূল্যের কারণে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে এমন সংখ্যাই বেশি। 

সবচেয়ে কষ্ট হলো- সয়াবিন তেল নিয়ে টানা দু’বছর ধরে রীতিমতো তেলেসমাতি কারবার চলছে। এক বছরে প্রতি লিটারে দাম বেড়েছে ৬৩ টাকার মতো। আর দুই বছর আগে প্রতি লিটার সয়াবিন ছিল ৮৫ টাকা। এই হিসাবে এখন কত বেড়েছে? অথচ কারো যেন কোনো যন্ত্রণা নেই! 

মানছি পণ্যটি পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ চলছে। ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রপ্তানি বন্ধ ও আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেল রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে তেলের দাম লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বেড়ে যাবে? এটা কি স্বাভাবিক? যৌক্তিক?

একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। যদি অন্যসব পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকতো তাহলে আপদকালীন তেলের উচ্চ মূল্যের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। মানুষ এখন কয়টা সামাল দিবে? নিত্যপণ্যের সবকিছুর উত্তাপে পুড়ছে সবাই।   

তেল খেলে তো পেট চলবে না। শুধু যে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে বিষয়টি তো এমন নয়। যেখানেই হাত দেওয়া হয় সেখানেই তো আগুন! সাবান, পেন্সিল ব্যাটারি, নুডলস থেকে শুরু করে কোন নিত্যপণ্যটির দাম কম?

যখন বিশ্ব বাজারে সয়াবিন তেলের বাজার অস্থির তখন কি উচিত ছিল না দ্রুত তেল আমদানি বাড়ানো। অন্তত দুইমাসের প্রয়োজনীয় মজুত নিয়মিত রাখা? তা না করে উল্টো স্থানীয় বাজার থেকে রাতারাতি তেল সরিয়ে নেওয়া হলো। সরকার পরিস্থিতি মানুষের পক্ষে না নিতে পেরে, আমদানিকারকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তেল সিন্ডিকেটের দাবি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারদরের বেশি সয়াবিনের দাম নির্ধারণ করা হয়। যা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। 

নতুন দাম নির্ধারণের পরদিনই খবর আসে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে। এরসঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণের খবরটিও। তারপরও দাম কমানোর সাহস করেনি সরকার! 

মজার কথা হলো, ব্যবসায়ীদের এত সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরও বাজারে রাতারাতি সোনার হরিণ খ্যাত তেল সরবরাহ বন্ধ হলো কেন? দোকান থেকে তেল উধাও হলো কীভাবে? এজন্য কি এককভাবে খুচরা ব্যবসায়ীরাই জড়িত? মোটেই না। অথচ খুচরা ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান চলছে। চলুক। 

পরিস্থিতির কারণে তেলের বোতল এখন শিকলে বন্দি! তেল সরবরাহ কেন বন্ধ হলো? এ ব্যাপারে সরকার কারো কাছে আনুষ্ঠানিক জবাব চাইতে পারেনি। মানুষ কেন তেল পাচ্ছে না- এর জবাব দেবে কে? সরকার নির্ধারিত ১৯৮ টাকা লিটারের বোতলজাত তেল কেন ২১০ থেকে ২২০ টাকায় ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে? কেন তেলের গায়ে লেখা পুরনো দাম তুলে দেওয়া হয়েছে? 

একটি কোম্পানিকেও তো এই অপরাধে জরিমানা করতে দেখিনি। তবে কি তারা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে? তাদের জন্য কি কোনো আইন নেই? তাদের দোষ কি দোষ নয়? সবসময় সাধারণ মানুষের উপর জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন চলতে পারে না। একে সুশাসন বলে না। সুশাসন নিশ্চিত করতে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা উচিত।

সয়াবিন তেল নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। নানা অজুহাতে বিশ্ব তেল কারবারি সিন্ডিকেট চক্র দাম বাড়িয়ে বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম সংকট। এরসঙ্গে যুক্ত আমাদের দেশের তেল আমদানিকারকেরাও। মানুষের পক্ষে অবস্থান নিতে হলে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। অথবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যেকোনো মূল্যে আপস করে মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে, যেন দৃশ্যমান হয়। তা হয়তো সম্ভব নয়। 

পরিবহন সেক্টরে সরকার যেমন বেসরকারি মালিকদের কাছে জিম্মি তেমনি তেল ও চাল ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। কাউকে কিছু বলার সাহস নেই। তারা কি এতই শক্তিশালী? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে তাদের খুঁটির জোর কোথায়?

পরিবহন সেক্টরে সরকার যেমন বেসরকারি মালিকদের কাছে জিম্মি তেমনি তেল ও চাল ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। কাউকে কিছু বলার সাহস নেই। তারা কি এতই শক্তিশালী?

কিন্তু রাষ্ট্রের চেয়ে কি কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হতে পারে? তবুও আমার মতো বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করে সরকার কঠোর হলে তেলের দাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যেমন আমরা পেঁয়াজের ক্ষেত্রে দেখেছি।

খবর এসেছে, বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী, দাম আরও বাড়বে এমন আশঙ্কায় তেল বিক্রি কমিয়ে দিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। দেশের পাঁচ বড় শিল্প গ্রুপ ভোজ্য তেল আমদানিতে নেতৃত্ব দিলেও গত কয়েক দিনে এসব প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো, গত দুই মাসে চারবার তেলের দাম সমন্বয় করেও বাজার স্থিতিশীল করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এটি নিঃস্বন্দেহে বড় রকমের ব্যর্থতা।   

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম প্রতি টন প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডলার। সেই হিসাবে ১ লিটার বা কেজি তেলের দাম পড়ে ১ দশমিক ৯০ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর ক্রয়মূল্য পড়ে ১৬৫ টাকার কিছু কম বা বেশি। তাতেও সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

দোকান মালিক সমিতি বলছে, দেশে ভোজ্য তেলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের পরিকল্পনায় ঘাটতি থাকার অভিযোগ আনছে ব্যবসায়ী সমিতি। সমিতির কথাই যদি বলি, তাহলে মজুত করা তেল গেল কই? অভিযান যদি চালাতে হয় তবে সবখানেই চলুক। মুখ চিনে মুগের ডাল দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে তেলের মূল্যের দিক দিয়ে আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রায় ১৩৭ কোটি ডলারের তেল আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপরও তেলের বাজারে অস্থিরতা লেগেই আছে, এর সুরাহা চাই।
 
মে মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি জাহাজে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম ওয়েল এসেছে তিনকোটি তিনলাখ লিটার। পুরোটাই খালাস করে বন্দরের পাশে রাখা হয়েছে।  সেখান থেকে কোম্পানিগুলো নিজস্ব কারখানায় নিয়ে পরিশোধনের পর পরিবেশকদের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করবে। কিন্তু সেটা কত দিনে? তা যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়; বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি তেল আমদানি ও মজুত বাড়াতে হবে। সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে প্রেম বাদ দিয়ে মানুষের স্বার্থে দাঁড়ানো জরুরি। অন্যথায় তেলের গায়ের আগুন নেভানো সম্ভব হবে না।

রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক