গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বেশ উল্লাস প্রকাশ করছে। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন কিছু রাজনীতিকদের মতো গণরোষে পড়তে হবে মর্মে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে। বিএনপি নেতাদের গত কয়েকদিনের মন্তব্য শুনে একজন গবেষক হিসেবে এ দেশের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল। এই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে আমি বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করছি— কাকে আপনারা গণঅভ্যুত্থান আর গণরোষের ভয় দেখান? আপনারা কি ভুলে গেছেন দেশের সব গণঅভ্যুত্থান ও গণ বিস্ফোরণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই হয়েছিল? আর আপনারাই বার বার গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গণরোষের কবলে পড়েছিলেন। 

আপনারা একবার আফগানিস্তানের উদাহরণ দেন। আরেকবার পাকিস্তানের উদাহরণ দেন। আবার বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে। যখন সবাই অংক করে দেখাল বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না, তখন আবার আপনারা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন নেতাদের মতো গণরোষের শিকার হবে। এবার আপনাদের জন্য ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলো উপস্থাপন করি—

১) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইয়ুবের পতন হয়েছিল। বর্তমান বিএনপির আগের জেনারেশনের ক্ষমতাসীন অনেকেই তখন পালিয়েছিল। মুসলিম লীগ জেনারেশনের পরবর্তী জেনারেশন এবং তাদের সুবিধাভোগীদের নিয়েই সামরিক শাসক জিয়া বিএনপি গঠন করেছিল। বিএনপির পূর্বসূরিরাই উনসত্তরে গণরোষের শিকার হয়েছিল।

২) ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অনেকেই গণরোষের শিকার হয়েছিল। ওই স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রায় সবাই পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিল। আর জাতির পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই এ দেশের স্বাধীনতা এনেছিল। বিএনপির পূর্বসূরিরা ১৯৭১ সালেও গণরোষের মুখোমুখি হয়েছিল।

৩) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক এরশাদের পতন হয়েছিল। মওদুদ-শাহ মোয়াজ্জেমসহ বিএনপির অনেক নেতাই তখন স্বৈরশাসকের দোসর হিসেবে গণরোষে পড়েছিল।

৪) অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, চট্টগ্রামে নিহত না হলে সামরিক শাসক এরশাদের মতো জেনারেল জিয়ার পরিণতিও একই হতো। অর্থাৎ পৃথিবীর সব সামরিক শাসকের মতো গণঅভ্যুত্থানেই অবৈধ জিয়া সরকারের পতন হতো।

৫) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে গণআন্দোলনে মাত্র এক মাসে ভোট চোর খালেদা সরকারের পতন হয়েছিল। বিএনপির অনেক নেতা রাতের অন্ধকারে মন্ত্রীপাড়া থেকে পালিয়েছিল। গণরোষ থেকে বাঁচার জন্য অনেকে দেশ ছেড়েছিল। বিএনপির অনেক নেতাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেদিন মানবিক কারণে জনরোষ থেকে রক্ষা করেছিল। আবার কেও কেও গণরোষ থেকে রক্ষা পায়নি।

৬) সীমাহীন দুর্নীতি, অপশাসন আর ভোটচুরির নানা ষড়যন্ত্রের কারণে ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দুর্নীতিবাজ নেতাদের জনগণ লগি-বৈঠা নিয়ে ধাওয়া করেছিল। জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই পালিয়েছিল। অনেককেই সেদিন জনগণ পিটিয়েছিল।

৭) বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো গণঅভ্যুত্থান কিংবা গণ অসন্তোষ হয়নি। দেশের ইতিহাসে একমাত্র আওয়ামী লীগই সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল ২০০১ সালে। আর রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশ বিরোধী দুষ্কৃতিকারীরা সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা নিয়েছিল। এতে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। জাতির পিতার হত্যার পর খুনি মোশতাক-জিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য গণপ্রতিরোধ ও গণবিক্ষোভ মোকাবিলার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সামরিক আইন জারি করেছিল। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকা অবস্থায় খুনিরা সামরিক আইন জারি করেছিল নিজেদের সম্ভাব্য গণপ্রতিরোধ থেকে রক্ষার জন্য।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিএনপি-জামায়াতের নেতারাই বার বার শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। আর দেশের সব গণঅভ্যুত্থান ও গণ বিস্ফোরণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল। বিএনপির নেতারাই বার বার গণবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গণরোষের কবলে পড়েছিলেন। আপনাদের এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যের কারণে সেই ছবিগুলো এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। আপনাদের চোখে-মুখে তারপরও লজ্জার রেশ দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আপনাদের জন্য প্যান্ডোরার বাক্স।

ড. সেলিম মাহমুদ
তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ