বাংলাদেশে বর্তমানে মোট উদ্যোক্তার ৩১.৬ শতাংশই নারী। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই কাজ করে এই দেশের নারীরা নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছেন। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়ে। সন্দেহাতীতভাবে এই সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে।

স্বল্প আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোতে নারীরা ব্যবসার সুযোগ পেয়ে নয়, মূলত প্রয়োজনের তাগিদেই উদ্যোক্তা হন। শুধু ই-কমার্সের ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপক হারে নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন। যদিও পরিসর খুব ছোট, তবে সহায়তা পেলে এই খাত যথাসম্ভব উন্নতি করবে বলে মনে করি।

নারীরা আগে অনেক অবহেলিত ছিলেন। কাজ করার জন্য অনুমতি মিলত না, অনুমতি মিললেও কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। মূলধনের সংকট ছিল, সমাজের রক্তচক্ষুর ভয় ছিল, ধর্মীয় কারণ ছিল।

২০২০ সাল থেকে করোনার প্রকোপে অসংখ্য পরিবারের ওপর নেমে এসেছে অর্থনৈতিক সংকট। সেই সংকট এখন কিছুটা লাঘব হয়েছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। ঘর থেকে বের হয়ে নারীরা কাঁধে নিয়েছেন পরিবারের হাল। আমরা পেয়েছি অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা।

শুরু হয়েছিল টিকে থাকার লড়াই দিয়ে, সেই লড়াই এখনো চলছে। সবাই শুধু সফলতার গল্পই শোনে, এর পেছনের কষ্ট কিন্তু কেউ দেখে না। অনেক নারী আছেন, যিনি পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সেই করোনাকালেই, অথচ তাদের ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ছিল না কোনো উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন। সেই জায়গা থেকে একজন নারীর ঘুরে দাঁড়ানো সহজ কোনো ব্যাপার ছিল না, কিন্তু তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

নারীর ছিল না কোনো পুঁজি, ছিল না কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কিন্তু গত প্রায় দুই বছর তারা নিজেদের উদ্যোগ ধরে রেখেছেন, উদ্যোগের পাশাপাশি বাড়তি আয় করছেন। সেই আয় দিয়ে নিজের সংসার চালাচ্ছেন। করোনার সময় থেকে নতুন পুরাতন মিলিয়ে প্রায় ৪ লক্ষাধিক নারী উদ্যোক্তা কাজ করে যাচ্ছেন আমাদের উই ফোরামে। তারা এখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ।

স্বল্প আয়ের অর্থনীতির দেশগুলোতে নারীরা ব্যবসার সুযোগ পেয়ে নয়, মূলত প্রয়োজনের তাগিদেই উদ্যোক্তা হন। শুধু ই-কমার্সের ক্ষেত্রেই বর্তমানে ব্যাপক হারে নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন।

অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়াতে উদ্যোক্তা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। প্রতি বছর বাজেটে নারীদের জন্য থোক বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে উদ্যোক্তা তৈরির কোনো পরিকল্পনা নেই।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা—অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন।

অর্থনীতিতে নারীর আরেকটি বড় সাফল্য হলো, উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী।

বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রাখছেন তারা। অনলাইনে বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা গড়ে তোলা এবং তা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা, যোগাযোগের উপায় ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে উই।

প্রথমে মনে করা হতো, নারী শুধু হস্তশিল্প, কিছু কুটির এবং ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে খুবই ছোট পরিসরে কাজ করবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বেশ বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়ে নারীরা এগিয়ে এসেছেন।

নারীর উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সরকারি ক্রয়েও অংশগ্রহণ করছেন, যদিও এই সংখ্যা সল্প, তবে তা বাড়ছে। এছাড়া করোনার সময় ই-কমার্সের জাগরণ সবারই জানা। নারী উদ্যোক্তারা বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব বেশি অবদান রাখছেন। যেটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে।

সমৃদ্ধি তখনই ঘটবে যখন নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকবে। প্রচলিত এবং অনলাইনে ব্যবসায় কর ছাড়, সব ক্ষুদ্র ও এসএমই উদ্যোক্তার ঋণপ্রাপ্তি সহজীকরণ এবং প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে একক সংস্থা গঠনে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নারীদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাৎসরিক ৫ লাখ টাকা ভ্যাট ট্যাক্সের আওতায় আনা উচিত। এছাড়াও ইনকাম ট্যাক্স অ্যাজামশন, জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স –বাজেটের বিষয় হিসেবেও রাখা আবশ্যক বলে মনে করি। নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক লোন, বিএসটিআই, ট্রেড লাইসেন্সের কাজ সহজীকরণ করাও জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা—অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছেন।

আর্থ-সামাজিক সচ্ছলতা উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নারীর যাত্রাকে সহজ করে দেয়। তবে কোনো ধরনের সমর্থন ছাড়াও যে কেউ চাইলেই উদ্যোক্তা হতে পারেন। একজনের অর্থনৈতিক-সামাজিক সচ্ছলতা না থাকতে পারে, কিন্তু যখন তার একটা বড় স্বপ্ন আছে, তিনিও সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সমান সম্ভাবনা রাখেন।

বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় নারীদের। স্বাভাবিকভাবেই, শুরুতে একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পূঁজি কম থাকে, তাই প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ীর চেয়ে ব্যাংক ঋণ পাওয়া একজন নারীর পক্ষে অনেক বেশি কঠিন।

ঋণ বা অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনেক সময় উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার ক্ষেত্রে সহজ পদ্ধতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ আদান প্রদানের সহজ ব্যবস্থা তৈরি করার বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। তাই আমার প্রত্যাশা শুধু বরাদ্দই নয়, একটি সুন্দর ও সুস্থ নারী উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতি তৈরি করতে প্রয়োজনীয় রূপরেখাও যেন বাজেটে থাকে।

সরকারি সহযোগিতা, নারী উদ্যোক্তাবান্ধব বাজেট থাকলে নারীরা সফলভাবে বিনিয়োগে আসবেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স অ্যাজামশন, জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স, ব্যাংক লোন, বিএসটিআই, ট্রেড লাইসেন্সের কাজ সহজীকরণ করলে এবং সেই সাথে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত কিছু আয়োজন করলে তারা তাদের কাজ সামনে তুলে ধরতে পারবেন। তাতে করে আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্য সামনাসামনি সবাই দেখতে পারবেন এবং এতে করে নেটওয়ার্কিং-এর একটা প্ল্যাটফর্মও তৈরি হয়।

নবীন উদ্যোক্তাদের পণ্য এক্সপোর্টে সহায়তা, এক্সপোর্ট খরচ কমিয়ে আনতে সরকার যদি পোস্টাল সার্ভিসকে ডিজিটাল করতে পারে এবং সেই সাথে রপ্তানি বিষয়ে যে ধরনের অনুমতিপত্র ও লাইসেন্স রেডি করতে হয় তা যদি আরও সহজ করে তাহলে বাংলাদেশের রপ্তানিতে আমাদের নারীদের বড় ভূমিকা থাকবে এবং সেই ভূমিকা আরও বাড়বে বলে আমি মনে করি।

করোনা বা দেশীয় পরিস্থিতি যাই হোক না কেন নারী উদ্যোক্তারা কিন্তু তাদের উদ্যোগ বন্ধ করে রাখেননি। তারা তাদের উদ্যোগ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চালিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন।

নারী উদ্যোক্তারা বর্তমানে যেভাবে নিজের সংসার এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার জন্য এগিয়ে এসেছেন, আমি বিশ্বাস করি সরকার সহযোগিতা দিলে, তাদেরকে সঠিকভাবে গাইড করতে পারলে, তারা দেশের অর্থনীতিকে উন্নত দেশের সমান উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।

নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com