বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার গুরুত্ব বেশি। ধর্মীয় তাৎপর্যের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির দিক থেকেও দুটি ঈদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ঈদকে কেন্দ্র করে রেমিট্যান্স আমদানি ও রপ্তানি দুটোই বৃদ্ধি পায়।

তাছাড়া, দেশীয় শিল্পের পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় বহুগুণে বেড়ে যায়। ঈদে যেমন জিনিসপত্র বিক্রয় থেকে আয় বাড়ে, তেমনি জিনিসপত্র ক্রয়েও ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে, জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়।

ঈদ উদযাপনকে আনন্দময় করতে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে রেমিট্যান্স পাঠায়। ৭ জুন ২০২২, গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশে আসছে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। গত পাঁচদিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

সদ্য শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২১ হাজার কোটি ডলারের কিছু বেশি। শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম পাঁচদিনেই প্রবাসী আয়ে জোয়ার দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে ২০২২-এ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল ৪২,২০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালের মধ্যভাগ থেকে হঠাৎ করেই বিভিন্ন কারণে ছন্দপতন হয় দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি আন্ত প্রবাহ রেমিট্যান্স খাতে। ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি। ঈদ উপলক্ষে রেমিটেন্সের এই তড়িৎ জোয়ার আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে আর্থিক বছরের শুরুতেই একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। 

চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে।

হজ পালন উপলক্ষে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুলসংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এই বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৭ হাজার ৫৮৫ জন পবিত্র হজ পালনের সুযোগ পাচ্ছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪ হাজার জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫৩ হাজার ৫৮৫ জন।

সরকারি ব্যবস্থাপনার প্যাকেজ-১ এর খরচ হচ্ছে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৪০ টাকা। প্যাকেজ-২ এ খরচ পড়বে জনপ্রতি ৫ লাখ ২১ হাজার ১৫০ টাকা। তাছাড়া, ২৬ মে ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী হজের সার্বিক খরচ ছাড়া প্রত্যেক হজযাত্রী ১২০০ মার্কিন ডলার বা এর সমপরিমাণ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে নিতে পারবেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। আর এই বছর বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার কারণে পশু কোরবানিতে এবার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। (প্রথম আলোর, ২৫/৬/২০২২)

কোরবানিকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক ও হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে। তাছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রায় ৮০-১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে।

গ্রামের মানুষগুলো জীবিকার তাগিদে চাকরি, ব্যবসা, কিংবা অন্য কোনো কাজের আশায় সাধারণত শহরমুখী হয়। কিন্তু, ঈদ আগমনের সাথে সাথে এর চিত্র বদলে যায়।

মানুষগুলো তখন শহর ছেড়ে শিকড়ের টানে ছুটে নিজ বসতবাড়ি গ্রামের পানে। ঝিমিয়ে থাকা মফস্বল ও গ্রামের হাট বাজারগুলো দিন কয়েক জন্য প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায়। ফলে গ্রামগঞ্জের হাট বাজারের অর্থনীতিও গতিশীল হয়ে ওঠে। গ্রাম ও শহরের যৌথ ক্রয়-বিক্রয়ের প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে তেজি ভাব পরিলক্ষিত হয়।

ঈদ উদযাপনের জন্য অনেক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে বেড়াতেও যায়। এক কারণে ঈদের কয়েকদিন আগে ও পরে ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় চোখে পড়ে। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক সময় দ্বিগুণ দামেও টিকিট বিক্রির খবর শোনা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে ঈদে ৩ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা আশা করা হচ্ছে।

ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত লেনদেনের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে। অনেক সময় তারল্য সংকটের কারণে কলমানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধার-কর্জ করে ব্যাংকগুলো।

ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসারই অর্থনীতি ধনাত্মক প্রভাব ফেলে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

৭ জুলাই ২০২২ ওভার নাইট কলমানি সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। অধিকন্তু, চামড়া ঋণ থেকে শুরু করে ঈদের বোনাস বাবদ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে মে ২০২২-এ মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৭.৪২ শতাংশ। অর্থনীতিতে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে এই ঈদে মুদ্রাস্ফীতি হার আরও তীব্রতর হয়ে জনজীবনে এক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর, এই ব্যাপারে আর্থিক কর্তৃপক্ষের অবশ্যই নজর রাখা উচিত।

ঈদ উপলক্ষে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসারই অর্থনীতি ধনাত্মক প্রভাব ফেলে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব, বিশ্ব বাণিজ্যের ধীর গতি, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে। এমন অবস্থায় ঈদকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেজিভাব ও দেশজ ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিময়তা ধরে রাখায় ভূমিকা রাখবে হলে আশা করা যায়।

তবে উৎসবের অর্থনীতিতে বেশকিছু সমস্যার কথাও শোনা যায়। জাল টাকার দৌরাত্ম্য, পকেটমার, অজ্ঞান বা মলম পার্টির কাছে গরু বিক্রেতা সর্বস্ব হারানো, চামড়া পাচার, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়া ক্রয়, ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা প্রতিবার ঘটলেও তা সমাধানে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার অভাব দেখা যায়।

তবে, এসব সমস্যাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ঈদ উৎসব আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়