পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন সর্বজনীন বাঙালির উৎসব, এই উৎসবের অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে অর্থনৈতিক কারণ ঘিরেই বর্তমান বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সম্রাট আকবর এর চালু করা বাংলা ক্যালেন্ডার বা বর্ষ পঞ্জিকা অনুযায়ী চলমান বাংলা মাসের গণনা হয়ে থাকে। আর সম্রাট আকবর এই নতুন ক্যালেন্ডারের সূচনা করেছিলেন সেই সময়ে কর আদায়ের হিসাব-নিকাশকে সহজ করার জন্য।

ওই সময় অর্থনীতি যেহেতু মূলত কৃষিনির্ভর ছিল তাই সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন এমনভাবে বছরের গণনা করতে যেন বছরের শুরুটা হয় কৃষকদের হাতে যখন কর দেওয়ার জন্য অর্থ থাকবে সেই সময়ে। আর এভাবেই ফসলের উৎপাদন ও ফসল ঘরে তোলার সময়কে ঘিরে বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা প্রণীত হয়েছে। সেই বর্ষ পঞ্জিকার প্রথম দিন বা পহেলা বৈশাখ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিগত বছরের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন হিসাব খোলার দিন বা হালখাতার দিন। বৈশাখের উৎসব মূলত এই হালখাতার উৎসব থেকেই শুরু হয়েছে।

ঐতিহ্য অনুযায়ী হালখাতার অর্থ হলো, হিসাব রেকর্ড করে নতুন খাতার সূচনা করা এবং পুরনো খাতায় বিগত বছরের দেনা পাওনা মিটিয়ে ফেলা। ফলে যারা বাকিতে জিনিস কিনেছিলেন তারা দেনা মিটিয়ে ফেলেন। আর নতুন খাতা খোলা উপলক্ষে ক্রেতা-বিক্রেতা, ব্যবসায়ীরা পরস্পর মিষ্টান্ন বিতরণ করে থাকেন।

যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে অতীতের মতো করে বড় পরিসরে হালখাতা উৎসব আর এখন নজরে আসে না, বিশেষ করে নগর অঞ্চলে। তবে গ্রামে এখনো হালখাতা অনেকাংশেই চালু রয়েছে। নগরে হালখাতার ঐতিহ্যবাহী উৎসব কম দৃষ্টিগোচর হলেও বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নানান ধরনের উৎসব অনুষ্ঠান কিন্তু চলমান রয়েছে, তার কলেবর বেড়েছে, তবে বৈশিষ্ট্য বদলেছে।

প্রাচীনকাল থেকেই এরূপ হালখাতার আনন্দ-উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে মেলা হয়, হয় যাত্রাপালা, বাউল গানের উৎসব, নানান রকমের খেলাধুলার আয়োজন। এভাবেই অর্থনৈতিক কারণ ঘিরে উদ্ভূত পহেলা বৈশাখের হালখাতা উৎসব সুযোগ করে দিয়েছে আরও অনেক ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশকে।

বৈশাখের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বৈশাখকে ঘিরে যে ধরনের পণ্যের কেনাবেচা হয় তা মূলত দেশীয় পণ্য। আর এ কারণেই বৈশাখের উৎসব যত বড় হচ্ছে, তত বেশি তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। বৈশাখে দেশীয় কুটির শিল্পের একটি বড় বাজার তৈরি হয়। সেই সাথে নানান ধরনের দেশীয় পোশাক, দেশীয় খাবার, হস্তশিল্পজাত গয়নাগাটি, ফুল, ইত্যাদি বড় পরিসরে কেনাবেচার সময় হল বৈশাখী উৎসব। তাই বৈশাখের সময় এই উৎসবকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। তাছাড়া বৈশাখ হলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসব। তাই বৈশাখকে ঘিরে পণ্য ও সেবা সামগ্রীর কেনাকাটার বৈচিত্র্যতা ব্যাপক।

বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বৈশাখী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তা বৈশাখের কেনাকাটাকে আরও বেগবান করেছে। দেখা গেছে যে, এই ভাতা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কারণ এই ভাতা পাওয়ার ফলে বৈশাখের সময়ে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বাড়ে। আর যেহেতু বৈশাখে দেশীয় পণ্যের চাহিদা থাকে তাই এই কেনাকাটার‌ ইতিবাচক প্রভাব একেবারে উৎপাদনকারী পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

বৈশাখ এখন এত বড় উৎসব বলেই গত বছর কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন থাকায় বৈশাখের উৎসব না হওয়ায় তা অনেক অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে বড় রকমের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি করেছিল। যেহেতু গতবছর মার্চ মাসের শেষের দিকে লকডাউন ঘোষিত হয়েছিল, ততদিনে বৈশাখের উৎসবকে ঘিরে নানা ধরনের পোশাক, কুটির শিল্প পণ্য উৎপাদন করেছিলেন উদ্যোক্তারা। তারা সেগুলো বিক্রি করতে পারেননি, কিন্তু উৎপাদনের খরচ হয়েছিল। তাদের অনেকেরই ব্যবসায় বড় রকমের লোকসান হয়েছে। তাদের অনেকেই আবার অতি ক্ষুদ্র অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তা বলে পরবর্তীতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুযোগ-সুবিধাও তারা পাননি।

বৈশাখের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বৈশাখকে ঘিরে যে ধরনের পণ্যের কেনাবেচা হয় তা মূলত দেশীয় পণ্য। আর এ কারণেই বৈশাখের উৎসব যত বড় হচ্ছে, তত বেশি তা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

এ বছরও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সবকিছু থমকে দিয়েছে। এই অবস্থায় উদ্যোক্তারা নতুন করে পড়েছেন চ্যালেঞ্জে। তাছাড়া বৈশাখের দিন যেসকল খাদ্যদ্রব্য কেনাবেচা হয়, পুতুল নাচ, বাউল গান, ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গান, নাচ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদির যে আয়োজন হয়, সেগুলোর পেছনেও অনেক অর্থনৈতিক লেনদেনের বিষয়ে আছে। বৈশাখের উৎসব না হওয়ার কারণে এই ধরনের পণ্য ও সেবা সামগ্রী বিক্রয় গতবার হয়নি, এবারও হচ্ছে না।

পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের উৎসব কেবল আমাদের ঐতিহ্যের ধারক নয়, এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে বৈশাখকে ঘিরে দেশীয় পণ্যের কেনাবেচা হওয়ার কারণে শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই উৎসব ভূমিকা রেখে চলেছে। এই ঐতিহ্যকে আমাদের ধরে রাখতে হবে এবং করোনার বাস্তবতায় নতুন করে ভাবতে হবে এই সংকটকালে কী করে দেশি পণ্যের কেনাবেচা অব্যাহত রাখা যায়।

যারা আর্থিকভাবে সক্ষম, ধনী তাদেরকে দেশি পণ্য কিনতে হবে বেশি বেশি করে, যাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থানে এই কেনাকাটা ভূমিকা রাখতে পারে। কোভিড-১৯ এর বাস্তবতায় পারিবারিক পর্যায়ে বৈশাখের উৎসব চলমান থাকুক। আর মূলত অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে এই উৎসবকে ঘিরে কেনাকাটাও অব্যাহত থাকুক। কারণ কেনাকাটা অব্যাহত থাকলে তা বহু মানুষের জীবিকাকে জীবন্ত রাখবে। অনেকে মনে করেন চারদিকে মহামারির হাহাকারে মানুষ কেনাকাটা কেন করবে? বুঝতে হবে যে এই কেনাকাটা কেবল বিলাসিতা নয়। বিভিন্ন রকম পণ্য কিনলে বাজারে তার চাহিদা থাকবে। আর পণ্যের চাহিদা থাকলে সেই পণ্যের উৎপাদনকারীরা তা বিক্রি করতে পারবেন এবং এর মাধ্যমে তাদের আয়-রোজগার অব্যাহত থাকবে। তবে সর্ব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে কঠোরভাবে - নিজেদের জীবনের প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে।

ড. নাজনীন আহমেদ ।। সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)