নিঃসন্দেহে, জিডিপি প্রবৃদ্ধিই জনগণের জীবনের মান বোঝার জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সূচক নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে জিডিপির পাশাপাশি অন্যান্য সম্পূরক সূচক (যেমন মানব উন্নয়ন সূচক) যদি উপস্থাপন করা হয় তাহলে একটি দেশের উন্নয়ন তথা অগ্রগতির সার্বিক চিত্রের সন্ধান মেলে।

আগে যে ৫.৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বানুমান করা হয়েছিল তখনও কিন্তু এই উন্নয়ন সহযোগীরা প্রবৃদ্ধির হার আরও কম হবে বলছিলেন। পরবর্তি সময়ে তারা কিন্তু তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের যে কথা বলছিলেন সেটাও কিন্তু আমাদের পূর্বানুমিত হারের কাছাকাছিই এসেছিল। 

তবে অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকদের কাছে জিডিপির চেয়ে উন্নতর সূচক যদ্দিন না মিলছে তদ্দিন এটিই তাদের বিচারে জনগণের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিমাপের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নিয়ামক হিসেবে গণ্য হতে বাধ্য। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এই প্রেক্ষাপট মনে রেখেই হালের জিডিপি হারের প্রাসঙ্গিক দিকগুলো নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই।

উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য অস্থায়িভাবে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪৩ শতাংশ। প্রাথমিক প্রাক্কলনের সময় কোভিড পরিস্থিতি বেশ আশঙ্কাজনকই ছিল। তাই ওই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকাটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তবে ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। ইতিবাচক প্রভাব শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির বিকাশের ওপর পড়েছে। আর সে কারণেই সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ২০২০-২১ অর্থবছরের চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধির হার হিসেবে দেখিয়েছে ৬.৯৪ শতাংশ। 

আমার মতে পূর্বানুমানের চেয়ে এই ১.৫১ শতাংশ বৃদ্ধিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ শুরু থেকেই আমরা বলে আসছিলাম প্রণোদনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করা গেলে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে বেগবান রাখা গেলে পূর্বানুমিতর তুলনায় প্রবৃদ্ধি আরও এক-দুই শতাংশ বেশিই হবে। 

অবশ্য অনেকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা যে ২০২০-২১ এর প্রবৃদ্ধি আরও কম বলেছে সে বিষয়টি নিয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আগে যে ৫.৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বানুমান করা হয়েছিল তখনও কিন্তু এই উন্নয়ন সহযোগীরা প্রবৃদ্ধির হার আরও কম হবে বলছিলেন। পরবর্তি সময়ে তারা কিন্তু তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে নতুন প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হারের যে কথা বলছিলেন সেটাও কিন্তু আমাদের পূর্বানুমিত হারের কাছাকাছিই এসেছিল। হয় তো অচিরেই তারা আবারও নতুন করে ২০২০-২১ এর জন্য চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধির হার বলবেন এবং সেটি নতুন সরকারি হিসাবের কাছাকাছিই হবে।

বিবিএস-এর হিসাবের সঙ্গে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিদের যে পার্থক্য তা নিয়ে খুব বেশি ভাবনার কারণ আসলেই নেই। তবে প্রবৃদ্ধির হারের এই ব্যাপক বৃদ্ধির পেছন কোন কোন বিষয়গুলো ভূমিকা রেখেছে তা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আশা করি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং বিবিএস এ নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তাদের প্রতিবেদনগুলোতে হাজির করবে। তবে খোলা চোখে প্রবৃদ্ধির পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে অভ্যন্তরীণ ভোগ।

২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর (বেইজ ইয়ার) ধরে যে হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের জিডিপির ৬৬ শতাংশের বেশি আসছে অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে। পুরোনো হিসাব (২০০৫-০৬ কে বেইজ ইয়ার ধরে) অনুসারেও এ অনুপাতে খুব রদবদল হয় না। কাজেই দেখা যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরের চাহিদাই আমাদের অর্থনীতির প্রধানতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। 
অভ্যন্তরীণ ভোগ (নতুন বেইজ ইয়ার অনুসারে) ২০১৯-২০২০ থেকে ২০২০-২১-এ প্রায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। এর প্রভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধিও হয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে আয় বৈষম্য বাড়লেও আমাদের ভোগ বৈষম্যের সূচক বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থিতিশীল আছে। এর মধ্যে প্রধানত ভোগের বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধির আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রের সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

করোনা মহামারির মধ্যে কৃষি দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য যেমন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছে, একই সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করেছে। এমন কি মহামারির চাপে শহর থেকে গ্রামে ফেরা মানুষের কাজের সুযোগও করে দিয়েছে এই কৃষি খাতই।

জিডিপি হিসাব করার সময় অভ্যন্তরীণ ভোগের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি ও রফতানির হিসাবও করা হয়। ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২১- এই দুই অর্থবছরেই আমদানি বেশি হয়েছে এবং রপ্তানি কম হয়েছে। ফলে নিট হিসাবে বৈদেশিক বাণিজ্য ঋণাত্মক। মনে রাখতে হবে আমাদের আমদানি ব্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ (অন্তত ৪০ শতাংশ) যাচ্ছে ‘ক্যাপিটাল মেশিনারিজ’-এর এবং কাঁচামালের পেছনে। আর সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদের শিল্প খাতে। কাজেই আমদানি হওয়া ওই মেশিনারিজ ও কাঁচামাল শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার কথা। 

বিবিএস-এর পরিসংখ্যানও বলছে যে আমাদের বৃহৎ শিল্পের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০.৬১ শতাংশ। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১৩.৮৯ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক অর্থায়নের গতি না বাড়া সত্ত্বেও এমএসএমই খাত নিজের চেষ্টাতেই এই সাফল্য দেখিয়েছে। প্রণোদনাসহ ব্যাংকিং খাতের প্রচলিত অর্থায়নের গতি যদি এদের দিকে আরও প্রসারিত করা যেত তা হলে প্রবৃদ্ধির হার নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি হতো।

আলাদা করে বলা দরকার কৃষির কথা। যদিও ২০১৯-২০২০ থেকে ২০২০-২১-এ প্রবৃদ্ধি ২.৩৭ শতাংশ থেকে ৩.১৭ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব আরও গভীরতর। করোনা মহামারির মধ্যে কৃষি দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য যেমন খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছে, একই সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করেছে। এমন কি মহামারির চাপে শহর থেকে গ্রামে ফেরা মানুষের কাজের সুযোগও করে দিয়েছে এই কৃষি খাতই।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি কতোটা কম বা বেশি হলো তার চেয়ে আমাদের উন্নয়ন কতোটা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব হলো- সেটিই বেশি প্রাসঙ্গিক ভাবনা বলে মনে হয়। আমাদের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের চিন্তা ও পরিকল্পনাও সে পথেই রয়েছে। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে উপস্থাপিত ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’য় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়লাভিত্তিক কতিপয় জ্বালানি প্রকল্প বন্ধ করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রসার, হাইড্রোজেন-হাব তৈরির মতো সুদূরপ্রসারি পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রবৃদ্ধির নীতি-কৌশলের কথা বলেছেন। পাশাপাশি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের পুরস্কার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় পথনকশা হিসেবে ইতোমধ্যেই হাজির করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’, এবং সে অনুসারেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে জীবনের গড় আয়ু, প্রাথমিক শিক্ষা ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে আমাদের মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন সূচকেও আমরা এশিয়ায় সেরা। তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি আদর্শ ভারসাম্য রক্ষা করেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর