ছবি : সংগৃহীত

২৪ জুলাই। বাঙালির মন খারাপের দিন। অভিনেতা উত্তম কুমারের তিরোধান দিবস। ১৯৮০ সালের প্রয়াত হন উত্তম কুমার। 

বাংলার চলচ্চিত্র জগৎ বা শিল্পজগৎ শুধু নয়, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছেন। উত্তম কুমারকে নিয়ে এই লেখাটা আমি লিখেছিলাম। আমি লিখেছিলাম কথাটা টেকনিক্যালি সঠিক হলেও এতে আমার বিশেষ কোনো মতামত নেই। লেখাটা মূলত পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় আর নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতা শেফালীর উত্তম কুমারকে নিয়ে স্মৃতিচারণার কিছু খণ্ড মুহূর্ত। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস’ নামক আর্কাইভে কাজ করাকালীন আমি পুরোনো দিনের অনেক চলচ্চিত্র শিল্পীদের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাতে পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, অভিনেতা, সিনেম্যাটোগ্রাফার, এডিটর, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, আর্ট ডিরেক্টর অনেক ধরনের শিল্পীই ছিলেন।

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?

এই লেখাটি তখনকার নেওয়া সাক্ষাৎকারেরই কিছু অংশ। এই সাক্ষাৎকারগুলো থেকে সেই সময়ের বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এক ধরনের মৌখিক ইতিহাস উঠে এসেছিল যেগুলো নিয়ে আমি বিভিন্ন সময় লিখেছি এবং ভবিষ্যতেও লিখব। 

যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সিনেমা আর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে তাদের নিজের নিজের মতামত ছিল। অনেকের সঙ্গেই অনেকের মতামত মিলত না। কিন্তু একটা জিনিস প্রায় তাদের সবার মধ্যেই কমন পেয়েছিলাম।

দুজন মানুষকে তারা সবাই খুব ভালোবাসতেন। এখনও বাসেন। ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, আত্মার-আত্মীয় মনে করতেন। একজন হলেন গ্রেট মাস্টার ঋত্বিক কুমার ঘটক আর দ্বিতীয়জন মহানায়ক উত্তম কুমার। তাদের সবাই যে এদের সঙ্গে কাজ করেছেন তা নয় কিন্তু, তা স্বত্বেও তাদের মনে এদের দুজনের উপস্থিতি চিরস্থায়ী।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সিনেমা কেন মানসম্মত না 

তখন যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাদের অধিকাংশই আজ বেঁচে নেই। অরবিন্দবাবু আর শেফালীও বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের কথাগুলো আছে। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। 

সময়টা ১৯৫৩। খ্যাতির মধ্যগগণে তখনও যাননি উত্তমকুমার। জনপ্রিয়তার গনগনে আঁচ তখনও গায়ে লাগেনি অরুণ চট্টাপাধ্যায়ের। নির্মল দে-র ছবি, পরিচ্ছন্ন পরিচালনা, আঁটসাট চিত্রনাট্যে অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক।

সেই ছবি দেখে সত্যজিত রায় বলেছিলেন, "ক্যামেরাকে তো পাত্তাই দেয় না দেখছি, অভিনয়ে থিয়েটারের গন্ধও নেই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং সাবলীল”। সুঠাম চেহারার উত্তম কুমারের যে ভবিষ্যৎ আছে সেদিনই আঁচ পেয়েছিলেন জহুরী সত্যজিৎ। 

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা 

আজও বাঙালির মননে একই রকম আবেগ ও শ্রদ্ধা উত্তম কুমারকে নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, কেন? ৪২ তম মৃত্যুদিবসেও মহানায়কের এমন অমোঘ আকর্ষণ কেন? আসলে, প্রতীভার সঙ্গে শ্রম আর সঙ্কল্প তাকে এই অনন্য উচ্চতায় তুলে আনে।

প্রথম থেকেই তিনি ‘উত্তম’ ছিলেন না। ‘অরুণ’ কান্তি ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ বলেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। কারণ, ক্যারিয়ারের প্রথম ৭টি ছবি পরপর ফ্লপ হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রি এই উপাধি উপহার দিয়েছিল তাকে। ক্রমে ‘উত্তম’ হয়ে ‘নায়ক’ এবং তারও পরে ‘মহানায়ক’-এর তার যে যাত্রা, তা আসলে বিচিত্রবর্গের এক প্রতিভার জেরে। মনে রাখার মতো অভিনয়-প্রতিভা তার সময়ে আরও অনেকের থাকলেও, তিনি যেন সবার চেয়ে আলাদা।

আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?

ঈশ্বর প্রদত্ত তার চেহারা নয়। অসম্ভব সব কষ্ট ও পরিশ্রমের পরেও অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে গভীর রোম্যান্টিক কণ্ঠস্বরে অপূর্ব ডায়ালগ-থ্রোয়িং, অসামান্য ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন এবং চরিত্র ও পরিপার্শ্ব মিলিয়ে সহজ কিন্তু নিটোল অভিব্যক্তি। তখন সাধারণ মানের গল্প, সাধারণ চিত্রনাট্য, সাধারণ সহ-অভিনেতাদের নিয়েও তিনি তাই বাংলা ছবির জুলিয়াস সিজার। 

সেই মহানায়কের ম্যাজিক আজও একই রকম অব্যাহত। তাই শুধু এই প্রজন্ম কেন তাকে মনে রাখবে আগত আরো হাজারো প্রজন্ম। সব প্রজন্মের রোমান্টিক হিরো উত্তম কুমার।