ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতিতে ভিন্ন মত থাকবে, ভিন্ন পথ থাকবে, মতবিরোধ থাকবে; এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু সেই সৌন্দর্যই হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের রাজনীতি থেকে। বাংলাদেশে ভিন্নমত মানেই প্রতিপক্ষ, মতবিরোধ মানেই শত্রু। সবাই যদি একই মতের হতো, তাহলে তো দেশে দল থাকতো একটাই।

আলাদা মত, আলাদা পথ আছে বলেই আলাদা আলাদা দল আছে। তবে আলাদা মত, আলাদা আদর্শ হলেই শত্রু হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যার যার মতো সে তুলে ধরবে। জনগণ যেটা গ্রহণ করবে, তাদেরকেই ভোট দেবে। মত যত ভিন্নই হোক, তবু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, সংলাপ মতবিরোধ কমিয়ে আনে।

আরও পড়ুন : বিএনপির লবিং এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ 

একটা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য আলাপ-আলোচনা জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই রাজনীতিতে সেই সুস্থতা অনুপস্থিতি। বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই দ্বিদলীয় ধারা বিদ্যমান। একটি ধারার নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ, আরেকটি বিএনপি।

এই দুই দলের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাদেরকে ঘিরেই আবর্তিত হয় রাজনৈতিক তৎপরতা। মুখোমুখি অবস্থান হলেও এই দুই দলের মধ্যেও আলাপ-আলোচনা ছিল। একসময় তারা সমান্তরাল অবস্থানে থেকে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।

পর্দার পেছনে যেমন পর্দার সামনেও এই দুই দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি, তবু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের সাথে বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপ; বাংলাদেশের রাজনীতির একটি আলোচিত অধ্যায়। কিন্তু অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অচলাবস্থা বিরাজ করছে। পর্দার সামনে তো নয়ই, পেছনেও দুই দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার কোনো লক্ষণ নেই।

আলাদা মত, আলাদা পথ আছে বলেই আলাদা আলাদা দল আছে। তবে আলাদা মত, আলাদা আদর্শ হলেই শত্রু হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যার যার মতো সে তুলে ধরবে। 

শুধু আদর্শ বা মতবিরোধ নয়; আওয়ামী লীগ আর বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান শত্রুতাপূর্ণ। এই শত্রুতাপূর্ণ অবস্থানের দায় অনেকটাই বিএনপির। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন : সহমতের রাজনীতি

শেখ হাসিনা কপালগুণে বেঁচে গেলেও আইভী রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছিল সেই হামলায়। পরে প্রমাণিত হয়েছে, তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপির পরিকল্পনায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেই সেই হামলা চালানো হয়েছিল।

আপনি যখন জানবেন, কেউ আপনাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চায়, তাহলে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনায় আপনি আগ্রহী হবেন না। তারপরও শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে আন্তরিকতার প্রমাণ রাখা হয়েছে।

বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন গুলশানে বিএনপি চেয়াপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে সেখানে কেউ ছিলেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর জন্য অফিসের গেটও খোলা হয়নি। বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে।

আরও পড়ুন : রাজনীতিই শেষ ভরসা

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করে বেগম খালেদা জিয়াকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু হরতাল থাকার অজুহাতে সে আমন্ত্রণে সাড়া দেননি বেগম খালেদা জিয়া। বরং প্রধানমন্ত্রীকে মুখের ওপর অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। এখন আপনি যদি আমন্ত্রণ গ্রহণ না করেন, দরজা না খোলেন আলোচনা হবে কীভাবে?

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এমনকি তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি।

বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ তো নেয়ইনি, বরং নির্বাচন ঠেকানোর নামে দেশজুড়ে সহিংসতা চালিয়েছিল। একতরফা সেই নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় বিএনপি নানা চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরা ঠেকাতে পারেনি। 

দাবি পূরণ না হলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সেই নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধিদল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকও করেছেন। সেই প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। কিন্তু সেই নির্বাচনে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি ঘটে।

আরও পড়ুন : মার্চে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান

এরপর থেকে বিএনপি আবার তাদের পুরোনো এক দফা দাবিতে ফিরে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে নেই। দুই পক্ষের এই অনড় অবস্থানে শঙ্কা তৈরি হয়েছে আগামী নির্বাচন নিয়ে।

সবাই চান আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু বিএনপি যদি তাদের দাবিতে অনড় থাকে তাহলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সবাই চান আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু বিএনপি যদি তাদের দাবিতে অনড় থাকে তাহলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি বরাবরই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তারপরও রাজনৈতিক সমঝোতা হলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।

সংবিধানও অপরিবর্তনীয় নয়। দুই দল সম্মত হলে সংবিধান সংশোধন করে যেকোনো ব্যবস্থাই প্রবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে দুই দলের মধ্যে যে অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তা ঘুচবে কীভাবে? 

আরও পড়ুন : জিয়া বীর উত্তম পদবির যোগ্য নয়

দূরত্ব কমিয়ে আনতে আলাপ-আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আলোচনার টেবিলেই সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে। ২৩ জুলাই ২০২২, এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি তো বলে দিয়েছি তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, পুলিশ যেন বাধা না দেয়।

বিশেষ করে বাংলা মটরে যে বাধা দেওয়া, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আসুক না হেঁটে হেঁটে যতদূর আসতে পারে। কোনো আপত্তি নেই। আমি বসাব, চা খাওয়াব। কথা বলতে চাইলে শুনব। কারণ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তবে যদি বোমাবাজি ও ভাঙচুর করে বাধা দেব, উপযুক্ত জবাব পাবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর এই কথায় কিন্তু একটা আলোচনার ইঙ্গিত আছে। তিনি বিএনপির কথা শুনতে চেয়েছেন। আমি মনে করি বিএনপির উচিত প্রধানমন্ত্রীর চায়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের দাবি তুলে ধরা।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশে কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে চা খেতে গেলে তো কোনো ক্ষতি নেই। এমন তো নয়, চা খেতে গেলেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে হবে। বরং বিএনপি বলতে পারবে, আমরা আন্তরিকতা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তুলে ধরেছি।

কিন্তু একদিনের মধ্যেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২৪ জুলাই ২০২২, জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘এসব হালকা কথা বলে লাভ নেই, চা-টা খাওয়ার কথা বলে লাভ নেই। একটাই কথা, পদত্যাগ করুন।’ তিনি বলেন, ‘তার আগে বলে দেন যে কেয়ারটেকার সিস্টেম মেনে নিচ্ছি, সেটা বলে দেন। তারপর চা-টা খাওয়ালে অসুবিধা নেই।’ 

সমস্যা হলো বিএনপির দাবি যত যৌক্তিকই হোক, আওয়ামী লীগ তা মানছে না, অদূর ভবিষ্যতে মানবে তেমন কোনো লক্ষণও নেই। দাবি মানাতে হলে আওয়ামী লীগের চাপ দিতে হবে অথবা তাদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে।

প্রেসক্লাবে বসে মির্জা ফখরুল দাবি করলেই তো শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন না বা দাবি মেনে নেবেন না। দাবি মানতে বাধ্য করার মতো আন্দোলন করতে হবে। কিন্তু তেমন আন্দোলন করার মত সক্ষমতা কি বিএনপির আছে?

আন্দোলন করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে চা খেতে যান, তার কাছে দাবি তুলে ধরুন। আন্দোলনও করবেন না, আলোচনাও করবেন না; তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? 

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com