ছবি : সংগৃহীত

টেলিভিশন টকশো-তে এখন একটি সাধারণ প্রশ্ন—রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে? বিশেষ করে জানতে চাওয়া হয় পাবনার রূপপুরে রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে চলা পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ—এই প্রকল্প বন্ধ হচ্ছে না, যেমন করে এত অর্থনৈতিক অবরোধের পরও ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস  যাওয়া বন্ধ হয়নি। কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজ—এ অবস্থান করা বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়বে না সেটাও ভাবা ঠিক নয়। যেকোনো রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা বা সংঘাত হলে তার সরাসরি প্রভাব অন্যান্য দেশেও এসে পড়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

ইউক্রেন-রাশিয়ার সামরিক সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাঁপুনি ধরবে কি না, সেটা যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বলা যাবে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন জুড়ে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হতেই জ্বালানি তেল আর ধাতুর বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ইউক্রেনে সংঘাতের পরিবেশ যত দিন বজায় থাকবে, তত দিন সোনার দাম বাড়তেই থাকবে এবং এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য রয়েছে। দেশ দুটিতে তৈরি পোশাক, পাটসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আবার গমসহ আরও বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে।

জ্বালানি তেলের বাজারে বড় প্রভাব ফেলতে পারে ইউক্রেন পরিস্থিতি। তেল উৎপাদনে রাশিয়া তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাই বহু দেশই জড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, উৎপাদন ধাক্কা খেলে তেলের জোগান তলানি ছোঁবে। তখন দামও চড়তে থাকবে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য রয়েছে। দেশ দুটিতে তৈরি পোশাক, পাটসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আবার গমসহ আরও বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়ে থাকে।

জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি আমদানি নির্ভর দেশ। এই সংঘাতের কারণে তেলের বাজার সম্পূর্ণভাবে অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। দ্রুতই দাম বাড়ছে। ২০১৪ সালের পর আবার তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারে পৌঁছেছে। এই দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে।

আমদানি নির্ভর সব দেশই সমস্যায় পড়বে, তাই বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। আর এতে করে বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারও চাপে পড়তে পারে। এর ফলে সার্বিকভাবে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এই যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রভাব প্রায় নিশ্চিত।

অতিমারির ধাক্কা এখনো কাটেনি। এইবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহ নতুন উদ্বেগ তৈরি করল বিশ্ব অর্থনীতিতে। যদি বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমাদের তৈরি পোশাক খাত রপ্তানির উপর প্রভাব পড়বে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব যদি দেশীয় জ্বালানি তেলের বাজারে পড়ে, যদি দাম বাড়ে তাহলে পরিবহন খরচ বেড়ে তৈরি পোশাকসহ সব প্রকার রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব রাখবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে পণ্য পাঠাতে বিলম্ব হতে পারে, যার কারণে বাজার হারাতে হতে পারে। এমনকি চাহিদায়ও সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে।

বিশ্বের কিছু অঞ্চলে এয়ার স্পেস ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা এসেছে বলে সমুদ্রের জাহাজ জট এবং জাহাজ ভাড়া আবারও বাড়তে পারে, এটা বাংলাদেশের চলমান ভোজ্য তেলের সংকটকেও আরও বাড়াতে পারে। তৈরি পোশাকের নতুন বড় বাজার রাশিয়া। ইউক্রেনেও কিছু পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। সরাসরি এই দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেয়।

আবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমেও দেশ দুটিতে বাংলাদেশের পোশাক যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সব দেশে পণ্য পাঠানোর জন্য জাহাজ পাওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। ঝুঁকির কারণে কোনো জাহাজ এই অঞ্চলে ভিড়তে চাইবে না। ক্রেতারাও রপ্তানি আদেশের বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। ফলে এই দুটি দেশে পোশাক রপ্তানি বিঘ্নিত হতে পারে।

এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে। বিশ্বের জ্বালানি, খাদ্য ও পণ্য বাজার অস্থিতিশীল হলে আরও এক দফা বাড়তে পারে দাম। এর ফলে অর্থনীতিতে নতুন একটা স্থবিরতা কাজ করতে পারে।

বিশ্বের গম আমদানির বড় অংশই রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে হয়ে থাকে। ফলে গমের বাজার পুরোপুরি বিঘ্নিত হবে। সাময়িকভাবে ওইসব দেশ থেকে রপ্তানি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ কমে গেলে খাদ্যের দাম বাড়বে। এ কারণে আমরা আশঙ্কা করছি, খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশে গম আমদানি করা হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ভারত থেকে। এর মধ্যে মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। প্রতি বছর বাংলাদেশ প্রায় ৫০ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে। এখন এই দুই দেশ থেকে লোড করার জন্য জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া এই দুই দেশের কারণে অন্যান্য দেশও সতর্ক। খাদ্যমূল্যের ওপর চাপ এলে এর প্রভাব অন্য পণ্যের ওপরও পড়বে। গমের দাম বাড়লে অন্য খাবারের দামও বাড়তে পারে।

এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ছে। বিশ্বের জ্বালানি, খাদ্য ও পণ্য বাজার অস্থিতিশীল হলে আরও এক দফা বাড়তে পারে দাম। এর ফলে অর্থনীতিতে নতুন একটা স্থবিরতা কাজ করতে পারে। জ্বালানি তেল সংকটের আশঙ্কা থেকে ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। কারণ, পামঅয়েল থেকে ইথানল তৈরি করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো যায়।

এক কথায়, রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিস্থিতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে বড়ভাবে প্রভাবিত করছে। যদি সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। পেট্রোলিয়াম পণ্য তেল-গ্যাসের দাম বাড়বে।

বাংলাদেশের মতো জ্বালানি আমদানিকারক দেশের জন্য এটা খারাপ খবর। সরকার ভর্তুকি সামাল দিতে তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করতে চাইবে। এমনটি করলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব মিলে তেল–গ্যাস, নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামালসহ খাদ্যমূল্য এবং ভোজ্য তেলের দাম আরও বাড়লে সরকারের রাজস্ব আয় এবং জনজীবনে আরও বেশি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি