ছবি : সংগৃহীত

১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। আমি যখন দেশ থেকে লন্ডনে চলে আসি। শেখ রেহানার বয়স তখন মাত্র ৮ বছর, সুতরাং তাকে দেখলেও খুব ছোটবেলায় দেখেছি।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে আসে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কারাগার ছিল ধানমন্ডির তখনকার ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে। বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত বঙ্গবন্ধু কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাদের আদরের কনিষ্ঠ বোন শেখ রেহানার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়।

সম্ভবত ২৪-২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেগড়া আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তার স্নেহের পরশ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই আমার অবর্তমানেই জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা ও আমার বন্ধু ড. ওয়াজেদ মিয়ার সুবাদে আমার এবং আমার স্ত্রী’র কথা পরিবারের সকলেরই জানা ছিল।

তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী বিদেশ থেকে পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের অংশগ্রহণ এবং প্রচেষ্টাও পরিবারের সকলের জানা। তাই হয়তো সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা আমাকে আপনজন হিসেবে সেই সময় গ্রহণ করতে অনাগ্রহী ছিলেন না।

আরও পড়ুন : শেখ রেহানা : আড়ালের দৃপ্ত মানুষ 

সেই থেকেই শেখ রেহানাকে দেখা ও তার মমতায় আশ্রয় নেওয়া, যা আমাদের পরিবারের সকলেই কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে। এই কথা বলার উদ্দেশ্য, তার এই পরিণত বয়সেও আমার পরিবার পরিজন সকলে তাদের দুই বোনের স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছি।

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনদের হারিয়ে, বাংলার জনগণ অভিভাবকহীন, আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর খন্দকার মোশতাক আহমেদ-জিয়াউর রহমানের অত্যাচারী শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জেল-জুলুম, হত্যা নির্যাতনের শিকার হতে থাকে তারা।

ভাগ্যক্রমে সেইসময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা প্রবাসে ছিলেন বলে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এই দীর্ঘ সময় তাদের সম্বল করে আমরা হানাদারমুক্ত বাংলাদেশের পরিবর্তে যে স্বৈরাচার পরিবেষ্টিত পাকিস্তানি অনুচরদের রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েছিলাম তাদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

এর জন্য যে আত্মসংযম, ত্যাগ, ধৈর্য, কর্মীবান্ধব নেতৃত্ব দরকার তা এই দুই বোন আমাদের দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি ভারতের নির্বাসন জীবন থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় তার প্রয়াত মায়ের নিকটাত্মীয় মোমিন উদ্দীন খোকা ভাইয়ের কাছে লন্ডনে চলে আসেন শেখ রেহানা।

এই দীর্ঘকাল প্রবাস জীবনে তিনি জীবন ধারণের জন্য একটি সম্মানজনক চাকরিতে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে পরিণত বয়সে অবসরগ্রহণ করেন। এই কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যেই সংসার, স্বামী, সন্তান, সকলের দেখভাল করে একটি ফুলটাইম চাকরি রক্ষা করেও তিনি দলীয় কর্মীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ! 

তার নির্দেশ উপদেশ মেনে ও তার সাহচর্যে থেকে বঙ্গবন্ধুর কর্মীরা প্রবাসে দিশেহারা জীবন থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীর সংগ্রামী জীবন গ্রহণ করেছিলেন।

শেখ রেহানার এই অক্লান্ত পরিশ্রমের সাংগঠনিক সক্ষমতার এক পর্যায়ে ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি জননেত্রী শেখ হাসিনা বোনকে দেখতে লন্ডনে আসার সুযোগ পান। শেখ হাসিনার লন্ডনে আসার ফলে ভারতসহ বহির্বিশ্বের কর্মীরা একজন যোগ্য নেত্রীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে এবং দূরালাপনীর মাধ্যমে যোগাযোগ আরও বাড়ানোর সুযোগ পান। কিন্তু এইসব কাজের মধ্যে যে কায়িক পরিশ্রম ও সকলকে দেখভাল করার পরিশ্রম সদ্য প্রথম সন্তানের জন্মদাত্রী শেখ রেহানা নিজ কাঁধে গ্রহণ করেন।

প্রবাসে তারই আশ্রয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমরা ব্রিটেনের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে ঘুরে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে একটি বিরাট জনসভা করার সুযোগ পাই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দাবি জানাতে সক্ষম হই। যার ফলে জীবিত প্রত্যক্ষ খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় কনফারেন্সে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান করে দল পুনর্গঠিত করে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যান।

আরও পড়ুন : শেখ রেহানা : এক দুঃখিনী রাজকন্যার গল্প 

শেখ রেহানা নিজের সন্তানের সাথে সাথে বোনের দুই সন্তানের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন এবং বোনকে বাংলার জনগণের সেবার জন্য বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের আদলে কাজ করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দিতে থাকেন।

প্রায় ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে শেখ রেহানা বোনের দেশ সেবার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। কোনো পদ-পদবি, সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করেননি।

বাংলাদেশের মতো একটি গরিব ও স্বল্প আয়ের দেশ যেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘চাটার দল’ দেশটাকে আজও খাবলে খাওয়ার চেষ্টা করছে, সেখানে জাগতিক সম্মান-মর্যাদা, বিলাস, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি এসব দূরে রেখে নির্মোহভাবে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত থাকা কেবলমাত্র ব্যতিক্রমী ও দৃঢ়চেতা মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়।

শেখ রেহানা এই অভিধায় আজ দেশবাসী ও বিশ্ব বাঙালির কাছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য কন্যার স্থানে আসীন। আমি তার শতায়ু কামনা করি।

সুলতান মাহমুদ শরীফ ।। বীর মুক্তিযোদ্ধা; সভাপতি, আওয়ামী লীগ, যুক্তরাজ্য