দেশের ছোট-বড় অনেক শহরেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন করেছে। বিষয়টি যে একেবারেই নতুন তা নয় তবে বেশ চমকপ্রদ। দীর্ঘ ছাত্র ও  শিক্ষকতা জীবনে প্রায় সবসময় দেখেছি যে, শিক্ষার্থীরা তাদের পরীক্ষা পিছানোর জন্য আন্দোলন করছে আর শিক্ষকরা ঘোষিত তারিখে পরীক্ষা গ্রহণে অনড়।  কিন্ত এবার শিক্ষার্থীরা সময়মত পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে।

মিছিল-মিটিং এ মুখরিত রাজপথ। অন্যদিকে সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয় পরীক্ষা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকর্তারাও ছিলেন অন্ধকারে। অথচ আইনানুযায়ী পরীক্ষা গ্রহণ করা বা না করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কমিটি/কাউন্সিলের। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের চিরায়ত প্রথাকেই অবজ্ঞা করা হলো। যা মোটেই কাম্য ছিল না।

বেশকিছু কারণে বিষয়টি ইতোমধ্যে দেশে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আহত করেছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষদের। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আকস্মিক ভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে ২৩ মে’২১ পর্যন্ত চলমান সকল পরীক্ষা স্থগিত ও ২৪ মে থেকে পরীক্ষা পুনরায় গ্রহণ করা যাবে মর্মে ঘোষণা করলে সাথে সাথেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে শিক্ষার্থীরা। এদিকে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের রাজপথ অবরোধের কারণে বিকেলে তাদের চলমান পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

সরকারি ঘোষণায় বর্ণিত সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট হলেও এমন বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে চরম ক্ষুব্ধ করে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অন্যদিকে দেশের প্রায় অধিকাংশ পাবলিক/সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করার দাবিতে এবং সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণ ও হল খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। যা এখনও অব্যাহত।

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় একবছর ধরে বন্ধ। কবে খুলবে তাও পরিষ্কার নয়। তবে দিনদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি সর্বমহলে জোরালো হচ্ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষাব্যবস্থায় এই মুহূর্তে বড় ধরনের একটি সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে।

সরকার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে পরীক্ষা ২৩ মে পর্যন্ত স্থগিত করার কথা বললেও বাস্তবে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি কার্যকরভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ সমূহে পরীক্ষা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজের পরীক্ষা গ্রহণে সরকার তাদের অনাপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা চলমান রয়েছে। এইসময় বৈষম্যমূলক সরকারি সিদ্ধান্ত সার্বিক বিষয়কে জটিল করে তুলেছে। অন্যদিকে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও তাদের পরীক্ষার বিষয়ে পজিটিভ কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিরাজ করছে।

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় একবছর ধরে বন্ধ। কবে খুলবে তাও পরিষ্কার নয়। তবে দিন দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি সর্বমহলে জোরালো হচ্ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় শিক্ষাব্যবস্থায় এই মুহূর্তে বড় ধরনের একটি সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। অথচ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ইউজিসি, শিক্ষামন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় একসাথে বসে পরিস্থিতির খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হয়তো খুব সহজেই আজকের পরিস্থিতি এড়ানো যেতো।

মূলত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বলা হলেও পথে-ঘাটে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। পর্যটন স্পটগুলো মানুষে মানুষে ভরে গেছে। বাসে-ট্রেনে-বিমানে স্বাস্থ্যবিধি ,আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। পথ-ঘাট, হাট-বাজার, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা সবকিছুই চলছে অনেকটা স্বাভাবিক গতিতে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নজরদারি বা তদারকি নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে একধরনের অচলাবস্থা।

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

আমাদের সবারই জানা যে, দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও সরকার সেই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রচলিত বিধি বিধান এবং প্র্যাকটিসকে তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে ২৩ মে পর্যন্ত সকল পরীক্ষা বন্ধ করায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের একাডেমিক অর্ডিন্যান্সের আওতার মধ্যে থেকে কবে, কখন, কিভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে এবং ফলাফল প্রকাশ করা হবে তা নির্ধারণ করা থাকলেও এবার সম্পূর্ণ একটি ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে পূর্বে আলোচনা করলেই তা শোভন হতো। কিন্তু তা করা হয়নি।

ছাত্রদের অভিযোগ, কারো কারো  মাত্র দু-একটি কোর্সের পরীক্ষা বাকি থাকলেও বা এক-দুটি ল্যাব পরীক্ষা বাকি থাকলেও হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত তাদেরকে একাডেমিকভাবে পিছিয়ে দেবে। অন্যদিকে আর্থিকভাবে তারা পুনরায় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। একই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে একই দেশে পরীক্ষা গ্রহণে দু'রকমের নিয়ম করায় ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

একাধিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা আর হয়নি। আসলে কবে, কিভাবে, কখন, পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালা খোলা হবে, শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা জীবনে ফিরে যাবে, আবাসিক ছাত্ররা তাদের হলে প্রবেশ করবে তা এখনও অনিশ্চিত। যদিও সরকারি ঘোষণায় তা ১৭ মে খুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন দেখার পালা বাস্তবে কি হয়।

এমতাবস্থায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা না গেলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বিক্ষোভের মাত্রা হয়তো বৃদ্ধি পেতে পারে। ছাত্রদের মধ্যে হতাশা বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় অত্যন্ত সুচিন্তিত, বাস্তব ধর্মী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান বের করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের মঙ্গল হয়।

ড. মো. হাছানাত আলী ।। অধ্যাপক, আইবিএ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

drhasnat77@gmail.com