ছবি : সংগৃহীত

‘কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজটি করাতে হবে। আমি কার ওপর বিশ্বাস রাখব’? এই আক্ষেপ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীকের। কেন আক্ষেপ সেটা এর মধ্যে সবাই আমরা জেনে গেছি। আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

একটি বা দুটি নয়, ফাঁস হয়েছে ছয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র। আর ফাঁসে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি একজন কেন্দ্রসচিব, অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক, যার দায়িত্ব হলো নিরাপদে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। ঘটনা ঘটেছে দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। ঘটনাটি ধরা পড়ে মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর)।

যে কোনো পরীক্ষায়, সেটা একাডেমিক হোক বা চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা হোক, প্রশ্নপত্র ফাঁস এক সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যাটি আমাদের সবাইকে বিচলিত করছে, যেমনটা বিচলিত হয়েছেন, হতাশ হয়েছেন সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি? 

আমি নিজে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার কমিটিতে আছি। দেখছি শিক্ষকরা কতটা শ্রম দিচ্ছেন, কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করছেন। আর সেটা যেন ফাঁস না হয় তার জন্য কতটা সতর্ক থাকছেন। এরপরও যদি ফাঁস হয়ে যায় কোন না কোন স্তর থেকে তাহলে হতাশার অন্ত থাকে না।  

একটা সময় আমরা দেখছিলাম হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বা ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন কৌশলে ফাঁস করছে, তারা নিত্যনতুন কৌশল নিচ্ছে। তারা ডিজিটাল ডিভাইসকে সক্ষমতার সঙ্গে ব্যবহার করছে।

একজন শিক্ষার্থী সারাবছর ঠিকভাবে শিখছে বা পড়ছে কি না, একটি পরীক্ষার মাধ্যমে তার বিচার সম্ভব? এই ধারণাটিই সমস্যার। সেই সমস্যারই বর্ধিত রূপ কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ভাবনা

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় অনেকে ধরাও পড়েছে। কিন্তু খোদ শিক্ষক, কেন্দ্রসচিব যখন কাজটি করেন তখন বুঝতে হয় সমস্যাটি কোনো প্রযুক্তি বা বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়, সমস্যা সমাজের মনস্তত্ত্বের, সমস্যা পরীক্ষা ব্যবস্থায়।

শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে আমরা কাঠামোর কথা ভাবতে পারি। মাধ্যমিক পরীক্ষার গুরুত্ব আছে। কিন্তু তাকে যেভাবে জীবনের সর্বস্তরে প্রবেশের ভিত্তি বানিয়ে ফেলেছি তার পরিবর্তন আসা দরকার। বোর্ডের পরীক্ষা, সব পরীক্ষার্থীর জন্য একই প্রশ্নে একই সময়ে পরীক্ষা দিলে কে ভালো আর কে মন্দ, তা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে যায়। বিষয়টি এমন ভাবাই ভুল।

কোনো একজন শিক্ষার্থী সারা বছর ঠিকভাবে শিখছে বা পড়ছে কি না, একটি পরীক্ষার মাধ্যমে তার বিচার সম্ভব? এই ধারণাটিই সমস্যার। সেই সমস্যারই বর্ধিত রূপ কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ভাবনা। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের নিকট এই বোর্ডের পরীক্ষা জীবনমরণের প্রশ্ন হয়ে উঠে।  সারা বছর যাই হোক, যেকোন মূল্যে বোর্ডের পরীক্ষাটি পাস করতে তারা মরিয়া হয়ে যায়। এবং সেখান থেকেই সমস্যা শুরু।

আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, সেটা থাকুক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর আছে, সেটাও থাকতে হবে। কিন্তু, তার মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস করার সমস্যা দূর হবে বলে মনে হয় না। কারণ হলো, এটা আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে, সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। 

শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা, এটাই এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি, এটা বোর্ডের পরীক্ষা এসব ধারণাকে দূর করতে হবে। বরং আমরা এমন একটা পদ্ধতির কথা ভাবি যেখানে প্রতিটি স্কুলেরই নিজস্ব মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকবে। উচ্চতর শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও ছাত্র বাছাই করবার সময় নিজস্ব মাপকাঠি ব্যবহার করবে। শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখল, তা মূল্যায়নের মূল উদ্দেশ্য যে কোনো মূল্যে মাধ্যমিকের ঘাট পার হওয়ার ক্ষমতা নয়। 

প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতারা জাতির মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করছে এবং সেটা তারা করছে কোটি কোটি টাকার লোভে। সমাজ ও রাষ্ট্র যেন এক দুষ্টচক্রের পাল্লায় পড়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের শাস্তি দিতেই হবে

এটি আমার ভাবনা। সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার অনিয়ম সম্পর্কে সমাজের বড় ভূমিকা রয়েছে। স্থানীয় স্তরের মেজো-সেজো নেতারা যখন প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে পড়েন বা ফাঁসকারীদের আশ্রয়প্রশ্রয় দেন তখন সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আরও কঠিন হয় যখন খোদ অভিভাবকরাই সন্তানের জন্য রাতের আঁধারে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খোঁজেন হন্য হয়ে। দেশে দুর্নীতি কতটা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে সেটা বোঝা যায় অভিভাবকদের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে। 

আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার, আমাদের মানসিকতা ও বাস্তবতা 

এটি একটি দুর্নীতি এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বয়কট করতে হবে সামাজিকভাবে। আশঙ্কা এখানেই যে, উচ্চ শিক্ষিত মানুষরাও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ পুরো বিষয়টি দেখতে হবে গুরুতর অপরাধ হিসেবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যখন শিক্ষকরা যুক্ত হয়ে পড়েন, তখন তা বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এ ঘটনা সমাজের আশঙ্কাজনক অবক্ষয়েরও প্রকাশ। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতারা জাতির মেধাবী সন্তানদের বঞ্চিত করছে এবং সেটা তারা করছে কোটি কোটি টাকার লোভে। সমাজ ও রাষ্ট্র যেন এক দুষ্টচক্রের পাল্লায় পড়েছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু সমাজের ভাবনাটা বড়। সামাজিক এমন অবক্ষয় রোধে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও মানসিকতা উন্নত করার কর্মসূচি না থাকলে, শাসন ব্যবস্থায় ন্যায্যতা না থাকলে প্রশ্নপত্র ফাঁস তো অব্যাহতই থাকবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন