ছবি : সংগৃহীত

নতুন আঙ্গিক ও ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বেশিদিন হয়নি। ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দৈনিক বাংলা এরই মধ্যে পাঠকের নজর কেড়েছে। কিন্তু তার এই নতুন প্রকল্পের পূর্ণ বিকাশ তিনি দেখে যেতে পারেননি।

৮৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনার, তবে অপ্রত্যাশিত নয়। অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে ছিলেন। তাই তার মৃত্যুর খবরের জন্য এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিলই। তারপরও তোয়াব খানের মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন।

সত্যি সত্যি তার মৃত্যুতে সাংবাদিকতার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন করে গেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবন আলো ছড়াবে আরও বহুদিন, বহু যুগ।

আরও পড়ুন : অমিত হাবীব : বার্তা কক্ষের নেতা 

১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল সাতক্ষীরার রসুলপুর গ্রামে তার জন্ম। সাংবাদিক হওয়া আসলে তার নিয়তিই ছিল যেন। মামা মাওলানা আকরাম খাঁর পথ ধরেই তার এগিয়ে যাওয়া। ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার মাধ্যমে তার সাংবাদিকতার শুরু। সেই হিসেবে তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার ৭১ বছরের।

১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক হন। ১৯৬৪ সালে যোগ দেন দৈনিক পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি দৈনিক পাকিস্তান থেকে বদলে যাওয়া দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদকের দায়িত্ব পান তোয়াব খান।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। এই বিরল দায়িত্ব পালনকালে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে, দেখেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় বদলে দিতে বঙ্গবন্ধুর নিরন্তর লড়াই।

দৈনিক পাকিস্তান হয়ে দৈনিক বাংলার দীর্ঘ পথচলায় তিনি প্রমাণ করেছেন, সরকারি মালিকানার একটি পত্রিকাও কীভাবে সাংবাদিকতার উৎকর্ষ স্পর্শ করতে পারে। তার সম্পাদনায় দৈনিক বাংলা সাংবাদিকতার উচ্চ মানদণ্ড স্থাপন করেছিল।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। যা তার ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব ছিলেন। এই বিরল দায়িত্ব পালনকালে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে, দেখেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় বদলে দিতে বঙ্গবন্ধুর নিরন্তর লড়াই।

১৯৮৭-১৯৯১ সাল পর্যন্ত তখনকার রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদেরও প্রেসসচিব ছিলেন তিনি। এছাড়া ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবেও।

আরও পড়ুন : প্রত্যাশা বেশি বলেই সমালোচনা বেশি

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ছিলেন। তার লেখা ও উপস্থাপনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত ‘পিন্ডির প্রলাপ’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছিলেন একুশে পদক।

দৈনিক জনকণ্ঠের শুরু থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। তোয়াব খানের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল দৈনিক জনকণ্ঠ। নব্বইয়ের দশকে তোয়াব খানের নেতৃত্বে প্রকাশিত জনকণ্ঠ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসেরই একটি নতুন বাঁক।

অন্যরকম গেটআপ মেকআপ আর ঝকঝকে ছাপায় দৈনিক জনকণ্ঠ প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে উঠেছিল। একই সঙ্গে দেশের চার জায়গায় ছাপার ধারণা দিয়ে তিনি বদলে দিয়েছিলেন সংবাদপত্রের ইতিহাস। যেখানে বিকেলে বা একদিন পর দৈনিক পত্রিকা পৌঁছাত, সেখানেও তিনি জনকণ্ঠকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সকালে সকলের নাস্তার টেবিলে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ছিলেন। তার লেখা ও উপস্থাপনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচারিত ‘পিন্ডির প্রলাপ’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অল্প কিছুদিন তোয়াব খানের নেতৃত্বে জনকণ্ঠে কাজ করার। তোয়াব খান সাংবাদিক হিসেবে কেমন ছিলেন, তার সাথে কাজ না করলে পুরোপুরি বোঝা মুশকিল।

তোয়াব খান ছিলেন সার্বক্ষণিক একজন সাংবাদিক। সংসার-সন্তান থাকলেও তোয়াব খান আসলে আমৃত্যু ঘর করেছেন সাংবাদিকতার সাথে। জনকণ্ঠে সবচেয়ে কম বয়সী মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু আমরা কখনোই তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারতাম না।

আরও পড়ুন : মিশুক স্যার : ব্রডকাস্ট সাংবাদিকতার স্টাইলশিট 

তোয়াব খান অফিসে আসতেন সবার আগে, যেতেন সবার শেষে। জনকণ্ঠের রিপোর্টারদের সবচেয়ে বড় ক্লাসরুম ছিল তার মিটিং। প্রতিদিন সকাল ১০টায় মিটিংয়ে উপস্থিত থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এই মিটিং নিয়ে রিপোর্টারদের অনেকে বিরক্তও ছিলেন। কিন্তু প্রতিদিনের সেই মিটিংয়েই পরিকল্পনা হতো পরদিনের পত্রিকার।

সেই মিটিং থেকেই পরদিন বেরুতো দৈনিক জনকণ্ঠ। যারা তখন বিরক্ত হয়েছেন, এখন নিশ্চয়ই তারা স্বীকার করবেন, তোয়াব খানের প্রতিদিনের সেই মিটিং সমৃদ্ধ করেছে সবাইকেই। সেইসব মিটিংয়ে শুধু প্রতিদিনের সাংবাদিকতা নয়, উঠে আসতো সাংবাদিকতার ইতিহাসও।

সকাল ১০টায় মিটিংয়ে নেতৃত্ব দিয়ে দিন শুরু করা তোয়াব খান বাসায় ফিরতেন সবার শেষে পত্রিকার পোস্টিং শেষ করে। উপদেষ্টা সম্পাদক হলেও তিনি পত্রিকার শিরোনাম থেকে শুরু করে পোস্টিং সবকিছুই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। তার নজর এড়ানোর সাধ্য কারো ছিল না।

আরও পড়ুন : গণমাধ্যম আইন : নিশ্চিত হোক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা 

আমি তখন মাঝে মধ্যে খেলাধুলার পাতার পোস্টিং করতাম। তিনি এক পলক দেখেই চট করে ভুল ধরিয়ে দিতেন। পোস্টিং রুমে তাকে দেখলেই আমরা ভয়ে কাবু হয়ে যেতাম, এই বুঝি পাল্টে দিলেন। তবে যে পরামর্শ দিতেন তাতে চট করে পাল্টে যেত পাতার চেহারা। মালিকপক্ষের অপেশাদার মনোভাবে কারণে জনকণ্ঠ তার শীর্ষস্থান হারিয়েছে বটে, তবে তোয়াব খান তার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন ছিলেন এবং থাকবেন।

আগেই যেমন বলেছি, তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। সংবাদ ছাড়া তার মাথায় আর কিছুই থাকতো না। প্রিয়তম কন্যার মৃত্যুর পরদিনও অফিসে এসে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি।

সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতা প্রজন্মের শেষ মানুষদের একজন তোয়াব খান। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটল।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ