অচল ডেমু সচল হয়েছে আমাদের দেশীয় প্রকৌশলী এবং কর্মীদের অদম্য মেধা আর কর্মশক্তিতে। প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান এবং তার টিম এই অসাধারণ কাজটি করে কেবল একটি চ্যালেঞ্জেই জয়ী হননি, সাশ্রয় করেছেন দেশের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

বছর কয়েক আগে ডেমু ট্রেনগুলো চীন থেকে কেনা হয়েছিল সাড়ে ৬০০ কোটি টাকায়। সেগুলোর মেরামতের খরচও প্রায় সমপরিমাণে চাওয়া হচ্ছিল। বিপুল অঙ্কের সেই টাকা জোগানোর চেয়ে ডেমু ট্রেনগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছিল সাশ্রয়ী। এমন ঘটনা এর আগেও এ দেশে ঘটেছে। অচল ফেরি সচল করার জন্য যে দেশ থেকে ফেরি কেনা হয়েছিল তারা যে মেরামত খরচ চেয়েছিল তার অর্ধেক টাকায় এ দেশের ফেরি প্রকৌশলী ও কারিগররা তা মেরামত করেছিলেন। অচল ডেমু ট্রেনগুলো সচল করার ঘটনা তার চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জে জয়ী এ কারণে যে, খুবই নামমাত্র টাকায় (৫১০০ টাকার সরঞ্জামে) ডেমু ট্রেনগুলোকে আবার কার্যোপযোগী করা সম্ভব হয়েছে।

প্রকৌশলী আসাদুজ্জামানের টিমের একজন সদস্য জুলহাস মিয়ার ভাষায়, ‘আমরা নিজ হাতে ট্রেনটি সচল করেছি। এমন কিছু সরঞ্জাম লেগেছে, বাজারে যার মূল্যই নেই। আমরা ইতিহাসের সাক্ষী হলাম। আমরাই একদিন ট্রেনের ইঞ্জিন তৈরি করব। আর কোচ-বগি তো বানাচ্ছিই।’ খুবই অসাধারণ আত্ম প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে এ নিবেদিতপ্রাণ টিম সদস্যের মুখে। এ রকম আত্মপ্রত্যয়ই আমাদের আশাবাদী করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে বাঙালি মেধাবী ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী এবং শ্রমজীবীরা। শারীরিক পরিশ্রম থেকে মেধার প্রতিযোগিতা কোথাও পিছিয়ে নেই আমরা। অচল ডেমু সচল করা তার একটি উদাহরণ। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, এ দেশে অদূর ভবিষ্যতেই সত্যে পরিণত হবে জুলহাস মিয়ার প্রত্যয়, ‌‌‘এ দেশেই তৈরি হবে রেলের ইঞ্জিন।’

‘বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এ দেশের একজন বিখ্যাত লেখকের সুপ্রসিদ্ধ উক্তি। কথাটির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সাজায় বিতার্কিকরা। অর্থাৎ একদল এই বাক্যকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠার যুক্তি সাজায়, আরেক দল বাক্যটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াসে বিতর্কে ব্রতী হয়। আমার কাছে মনে হয়, কথাটি সত্য এবং মিথ্যা একই সঙ্গে।

সংবাদটি পড়ে ভাবছিলাম, সাড়ে ৬০০ কোটি টাকায় এই শ্বেতহস্তীরূপী ডেমু ট্রেনগুলো কেনার সিদ্ধান্ত যে মহারথীরা নিয়েছিল তাদের নীতি-নৈতিকতা কোথায় ছিল? এগুলো কেনার আগে যারা পরিদর্শন করে এসে কেনার পক্ষে প্রস্তাব করেছিল তাদের মনে কি একবারও দেশের মঙ্গলের কথা উদয় হয়নি? তাদের ভেতরে কি কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো আবেগ কাজ করেনি? সব স্বাভাবিক আবেগকে গলাটিপে তারা এই অতি উচ্চমূল্যে ‘ডেমু-বেগ’কে অনুমোদন করেছিলেন মাত্র কয়েক বছর যা গার্বেজে পরিণত হতে পারে, তেমন জিনিস কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষ এমন উচ্চমূল্যে ক্রয়ের সুপারিশ করে? ‘নীতি’কে হত্যা করে তার বুকে পা রেখে দুর্নীতির কত উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল এর ক্রয় প্রস্তাবকদের দুর্নীতির মাত্রা! এ হচ্ছে ‘বেগ’ দিয়ে বিজ্ঞানের ‘আবেগ’ কেড়ে নেওয়ার পক্ষের ভাবনা।

পাশাপাশি প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান যার মেধা এবং শ্রম দিয়ে তার টিমের অদম্য উদ্যমে সেই স্তব্ধ, নষ্ট ‘বেগ’কে আবার ফিরিয়ে আনলেন রেল-ট্র্যাকে তার উক্তিতে আমরা আশাবাদী হই। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। আরও ১৪টি ডেমু অচল হয়ে আছে। সবগুলো সচল করতে পারলে বিজয়ী মনে করব।’

ওই একই বিজ্ঞান ‘বেগ’ দিয়েছে কিন্তু সেই ‘বেগ’ সুস্থ মানুষের ‘আবেগ’কে কেড়ে তো নেয়ইনি বরং সেই আবেগকে এক অনমনীয় প্রতিজ্ঞার আবেগে পরিণত করেছে। তারই অত্যুজ্জ্বল এক উদাহরণ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান। যিনি আমাদের ধ্বংসপ্রায় ‘নৈতিকতাকে’ দেশপ্রেমের চেতনায় পুনর্জীবিত করে তুলেছেন তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে।

একদিকে যদি দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা দেখি তাহলে আরেক দিকে আমরা দেশপ্রেমকেও খুঁজে পেয়ে আশাবাদী হতে পারি।

প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান বুয়েট থেকে পাস করে বিভিন্ন দেশে তার কৃতিত্বপূর্ণ পেশাজীবন কাটিয়েছেন। অনেক দেশই তাকে নাগরিকত্ব দিয়ে সেসব দেশের স্থায়ী বাসিন্দা করতে চেয়েছে। তিনি ব্যক্তিগত লাভের বিবেচনায়ও সেসব প্রস্তাবে রাজি হননি। দেশের জন্য কাজ করার প্রেরণায় দেশে ফিরে এসেছেন। আসলেই তো আমাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আর সে যুদ্ধ দেশ গঠনের। দেশের জন্য উচ্চতর আবেগ, উচ্চতর নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপনের।

দেশের জন্য কাজ করার এই উচ্চতর আবেগ এবং নৈতিকতার নির্মাণে শুধু প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খানই নয়, ইতিপূর্বে আরও অনেক মেধাবী দেশে ফিরেছেন, দেশে থাকছেন এবং দেশের জন্য আত্মনিবেদিত হয়ে কাজ করে চলেছেন। তারা কেউই প্রচারকামী নন, ‘আত্মপ্রচার’ যে ‘আত্ম-অবমাননা’ রবীন্দ্রনাথের কথায়ও উঠে এসেছে। কবি বলেছেন, ‘নিজেরে করিতে গৌরবদান নিজেরে কেবলই করি অপমান’ এ কথা তারা জানেন, জানতেন ফলে আমরা তাদের অবদানের কোনো মূল্যায়নই করিনি। না ব্যক্তিগত, পারিবারিকভাবে, না জাতীয়ভাবে এ বিষয়ে আমাদের দৈন্য অনেক।

আমি মনে করি, আমাদের জাতীয়ভাবে সেই দৈন্য অপনোদনের উদ্যোগ নিতে হবে। যারা আমাদের সামনে দেশপ্রেম, উচ্চ নৈতিকতা নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় উদাহরণ তাদের জাতীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করতে হবে। তাদের যুক্ত করতে হবে জাতীয় সব শুভ উদ্যোগের সঙ্গে, তাদের রাখতে হবে সর্বাগ্রে সবার সামনে; তাদের দৃষ্টান্তকে অনুসরণীয় করে তুলতে হবে।

নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বিজ্ঞানী প্রয়াত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, প্রয়াত প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী, জিন বিজ্ঞানী আবেগ চৌধুরী, এমন অনেক প্রতিভাবান মেধাবী মানুষের নাম আমরা নিতে পারি যারা স্বদেশের মানুষের জন্য অমূল্য অবদান রেখেছেন, রাখছেন। আমরা এদের অনন্য অবদানের সম্মিলিত অকুণ্ঠ স্বীকৃতি কি দিয়েছি বোধ করি নয়!

আমার মনে হয়, তাদের সম্মানিত করার উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে যারা দেশের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করে তাদের সেই অপকর্মকেও জবাবদিহিতায় আনা প্রয়োজন।

৫.

অচল ডেমু সচল হওয়ার সংবাদটি পড়ে আমার মনে এসব ভাবনার উদয় ঘটেছে। ভালো কাজের প্রশংসা এবং খারাপ কাজের তিরস্কার যদি না করতে পারি তাহলে আমরা আখেরে অচল ডেমুর মতোই পরিত্যক্ত ঘোষণার বিষয় এবং বস্তু হয়ে উঠব। তাই আমি মনে করি, এখনই শুরু করা প্রয়োজন। হতে পারে আসাদুজ্জামান খানকে দিয়েই তার কাজের জন্য ন্যূনতমপক্ষে সংসদে তার জন্য একটা ধন্যবাদ প্রস্তাব উত্থাপন এবং গ্রহণের মধ্য দিয়ে জীবিত অবস্থায়ই দেশপ্রেমিক, মেধাবী মানুষের কাজের প্রতি সম্মান জানানোর প্রথা চালু করে। প্রায় নামমাত্র মূল্যেই এটি করা সম্ভব এমনকি তা পাঁচ টাকার একটি জেল-পেনে যেমন নিউজপ্রিন্টের পাতায় আমি এ লেখাটি লিখছি তেমন মূল্যেও সম্ভব।

৬.

ধন্যবাদ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান খান আপনাকে এবং আপনার টিমের সদস্যদের। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতাকে প্রকৃত মুক্তির লড়াইয়ে পরিণত করতে হবে। ৩০ লাখ স্বপ্নের বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকারে।

সাইফুল আলম।। সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা