ছবি : সংগৃহীত

আঁতকে ওঠার মতোই খবর। সংযুক্ত আরব আমিরাতে মানব পাচারে জড়িত সরকারি সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো-বিএমইটি’র হর্তা-কর্তারাই। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল জনশক্তি রপ্তানিতে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিকার এবং প্রতিরোধের জন্যই। এখন সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি চক্র যোগসাজশে জড়িয়েছেন মানব পাচারের মতো অপকর্মে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

৮ অক্টোবর দৈনিকে সমকালের বিএমইটি’র কর্মকর্তাদের এমন অপকর্মের প্রতিবেদন চোখে পড়ে। এটা ওই গণমাধ্যমের নিজস্ব অনুসন্ধান প্রতিবেদন নয়। সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হলে আমরা দেখি, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ওই পক্ষ তা ভিত্তিহীন বলে প্রতিবাদলিপি দিয়ে প্রচার করে। এই প্রতিবেদন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে করা হয়েছে। অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে এমন জালিয়াতির তথ্য।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এমন জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পরও বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন তদন্তে নাম আসা অভিযুক্তরা। ঘটনার দায়ে যাদের নাম এসেছে তাদের হয়তো খুঁটির জোর বেশি। না হলে নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও কীভাবে স্বপদে তারা বহাল থাকেন? মন্ত্রণালয়েও সুশাসন কতটা নিশ্চিত তা সহজে অনুমেয়।

আরও পড়ুন : নারী পাচার কেন থামছে না? 

দেখতে পাই, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তর দুর্নীতির প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী কর্মীদের ভুয়া বহির্গমন ছাড়পত্র অর্থাৎ স্মার্টকার্ড দিয়েছে। অর্থাৎ চাকরি না দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা ভুয়া স্মার্ট কার্ডে কর্মীদের বিদেশ পাঠিয়েছেন।

বিএমইটির নয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ছয় রিক্রুটিং এজেন্সি জালিয়াতিতে জড়িত বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও স্মার্ট কার্ডে একই ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে বলে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।

মন্ত্রণালয় তাদের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা দিতে পারতো। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী তাদের সাময়িক বরখাস্ত করতে পারতো। মন্ত্রণালয় এমন কোনো ব্যবস্থাই এখনো পর্যন্ত নেয়নি...

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, শুধু রিক্রুটিং এজেন্সি নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে নেওয়া স্মার্ট কার্ড বিক্রি করা হয়েছে আদম ব্যবসায়ী এবং দালালদের কাছেও। এজন্য কর্মী প্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব ভুয়া স্মার্ট কার্ডে আরব আমিরাত গিয়ে বিপদে পড়ছেন কর্মীরা। দেশে গিয়ে এসব কর্মী না পেয়েছেন বৈধতা, না পেয়েছেন চাকরি।

সরকারি এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যে অপরাধ করেছেন তা বিভিন্ন আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মন্ত্রণালয় তাদের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা দিতে পারতো। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী তাদের সাময়িক বরখাস্ত করতে পারতো। মন্ত্রণালয় এমন কোনো ব্যবস্থাই এখনো পর্যন্ত নেয়নি।

মানব পাচার অপরাধের শিকার ব্যক্তিবর্গের সুরক্ষা, অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে সরকার একটি আইন করেছে। ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে যাবজ্জীবন শাস্তির বিধান রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা আদালতে প্রমাণ হলে দোষীদের যাবজ্জীবন সাজা হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আইনের কার্যকারিতা নিয়ে। কাজীর গরু গোয়ালে আছে কিতাবে নেই—এমন প্রবাদের মতো হলে ন্যায় বিচার কখনো নিশ্চিত হবে না।

মানব পাচারের এই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশই সঠিক তদন্ত অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তদের আইনের মুখোমুখি করতে পারে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন অর্থাৎ দুদকের। সংস্থার তফসিল অনুযায়ী এই অপরাধের আইনি ম্যান্ডেট তাদের।

প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জালিয়াতি, দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত অপরাধের অনুসন্ধান এবং তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান দুদক। আইনিভাবে স্বাধীন সংস্থা দুদক এই ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করতে পারে।

আরও পড়ুন : অবৈধ অভিবাসন : আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা 

যাদের নামে অভিযোগ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। দুদকের কাজও সহজ করে দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে অপরাধের সব তথ্য প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। এখন দুদক অনুসন্ধান করে প্রতিবেদনের আলোকে অপরাধের সত্যতা পেলে মামলা, গ্রেপ্তারসহ প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা কতটা চায় সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, ২৮ জুলাই মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে কার কী অপরাধ তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কারা দায়ী তাদের নাম রয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, মন্ত্রণালয় এই দুর্নীতির তদন্ত শেষ করেও কেন দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? বিএমইটি’তো প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই। মন্ত্রণালয় তার অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও কীভাবে স্বপদে বহাল থাকেন তদন্ত প্রতিবেদনে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিরা?

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কত মানুষ পাচার হন এই নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। ইউরোপীয় কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের ২২ জুলাই বিবিসি’র এক সংবাদে বলা হয়েছে, এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে প্রবেশ করেছে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ। অভিবাসন সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে পাঁচ হাজার মানুষ বাংলাদেশ থেকে এভাবে উন্নত দেশগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করে।

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের হৃদয়বিদারক অনেক তথ্যই আমরা কয়েক বছরে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে দেখেছি। গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালের কাছে সহজ সরল মানুষগুলো টাকা দেন। না জেনে বুঝে অবৈধ উপায়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। খেয়ে না খেয়ে নৌ পথে কীভাবে দিন কাটিয়েছেন বিদেশগামী এসব কর্মী এমন করুণ পরিণতির খবর আমরা দেখেছি। 

এতদিন আমরা দেখেছি এজেন্সি আর দালালদের প্রতারণা, আর এখন দেখছি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্রই জড়িত মানব পাচারে। মানুষ কোথায় যাবে? কোথায় প্রতিকার পাবে?

বিদেশ যেতে গ্রামের গরিব সাধারণ মানুষের প্রতারণার গল্প নতুন নয়। বছরের পর বছর এমন খবর আমরা দেখছি। যাদের মাধ্যমে দেশের সহজ সরল মানুষ বিদেশ যেতে প্রতারিত হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চোখে পড়েনি।

এতদিন আমরা দেখেছি এজেন্সি আর দালালদের প্রতারণা, আর এখন দেখছি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি চক্রই জড়িত মানব পাচারে। মানুষ কোথায় যাবে? কোথায় প্রতিকার পাবে? প্রতিকার পাওয়ার জন্য সরকার যে দপ্তর (বিএমইটি) করেছে সেখানকার চক্রই যদি পাচারে জড়িত থাকে তাহলে ভরসার জায়গা কোথায়?

আরও পড়ুন : সরকারি চাকরি কেন সবার প্রথম লক্ষ্য? 

যারা বিদেশ যায় তাদের বেশিরভাগই তরুণ। আমাদের আশা ভরসার এসব তরুণদের বিপদে ফেলে পকেট ভারি করছে বিএমইটির একটি চক্র। এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগে দোষীদের অভ্যন্তরীণ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে মানব পাচার প্রতিরোধ এবং দমন আইনের বাস্তবায়নে পুলিশের বড় ভূমিকা রয়েছে।

পাশাপাশি দুদক এসব ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে জনশক্তি রপ্তানিতে অনিয়ম-দুর্নীতি অনেকটা কমবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া যত দুর্নীতিমুক্ত হবে ততই ঝামেলামুক্ত থাকবে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা। যাদের শ্রমে ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাষ্ট্রকে তাদের গুরুত্ব বুঝতে হবে।

আদিত্য আরাফাত ।। সাংবাদিক