আত্মহত্যা মৃত্যু নয়! এটি হত্যা, নিজেকে নির্মমভাবে হত্যা করা। আমি যখন এ লেখা লিখছি, তখন পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১জন মানুষ নিজেকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পৃথিবী জুড়ে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী তরুণদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হলো এই আত্মহত্যা। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ছয়জন আত্মহত্যা করে থাকেন। আমাদের দেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে আবার গ্রামের মেয়েরা শহরের মেয়েদের তুলনায় বেশি আত্মহত্যা করে থাকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)- এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনাকালীন ১০ মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ও একই সময়ে আত্মহত্যায় ১১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যাদের একটি বড় অংশ তরুণ ও কিশোর বয়সী। একটি দেশে যখন করোনার চেয়ে আত্মহত্যায় বেশি মৃত্যু হয় তখন তা নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগায়।

করোনা পরিস্থিতিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ১৬জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কেবল করোনার সময় নয়, বিগত বছরগুলোতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ চিত্র কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়, আত্মহত্যার দিক থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অহরহ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ছয়জন আত্মহত্যা করে থাকেন। আমাদের দেশে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

একই চিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর থেকে মুক্ত নন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও।

বিগত বছরগুলোর আত্মহত্যার হার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,  বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)সহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। তবে, করোনাকালে যে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বেড়েছে একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬১ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ-তরুণী বিষণ্নতায় ভুগছেন।

করোনাকালে তাদের ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশের মানসিক চাপ অনেক বেড়েছে। এই সময় ২১ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণদের ভাবনায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। তরুণদের মধ্যকার আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার এই চিত্র কেবল বাংলাদেশের নয়। যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় বেশি। জাপানে কয়েক দশকের তুলনায় গত এক দশকে তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। 

প্রশ্ন হলো, সারা বিশ্ব জুড়ে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ছে কেন? গত এক বছরের করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজনে দীর্ঘদিন ঘরে থাকা, অনলাইন আসক্তির বাইরেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার নানাবিধ চাপ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, চাকরির সংকট, আর্থিক অনটন, মাদকসেবন, প্রেমে ব্যর্থতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিবারিক কলহসহ আত্মহত্যার নানাবিধ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তবে আত্মহত্যার কারণকে এইভাবে মোটা দাগে ব্যাখ্যা করলেই আমাদের দায় শেষ হবে না। বরং এখন প্রয়োজন একেবারে মাঠপর্যায়ের মৌলিক গবেষণা।

সময় বদলে গেছে। তার সাথে পাল্টে গেছে আমাদের জীবন ধারা। নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের জন্য যেমন জানার সুযোগ, কাজের সুযোগ বাড়াচ্ছে তেমনি তৈরি করছে নতুন নতুন সমস্যাও। আজকের আত্মহত্যার কারণের সাথে অতীতের কারণ কিংবা ভবিষ্যতের কারণ নাও মিলতে পারে। তাই আমাদের আরও ভাবতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে।

ইন্টারনেট আসক্তি, সমাজের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাকরিজীবী বাবা মায়ের সন্তানের জন্য সময় কম দেওয়া, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ফেসবুকের বিমূর্ত বন্ধুর মাঝে বুদ হয়ে থেকে সামনের বন্ধুকে ভুলে যাওয়া, ভিডিও গেমসের জগতে গিয়ে বিকেলে মাঠের ফুটবলের চল হারিয়ে যাওয়ার মতো কারণগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। 

আমাদের ভাবতে হবে শারীরিক অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। মনের অসুখ হওয়া মানে পাগল হওয়া নয়। আমাদের যেমন জ্বর-ঠাণ্ডা হয় তেমনি মনে হতাশাও আসতে পারে, রাগ হতে পারে, জীবন কখনো অসহ্য মনে হতেই পারে। শরীরে হরমোনের কম বেশি হলে আমাদের বিষণ্ন লাগতেই পারে। এই বিষণ্ন লাগা, হতাশ লাগা এগুলো কোনো বড় ঘটনা নয়। শরীরের রোগের মতো মনের রোগের চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে আমাদের সচেতন প্রয়াস আরও বাড়াতে হবে।

আমাদের ভাবতে হবে শারীরিক অসুখের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। মনের অসুখ হওয়া মানে পাগল হওয়া নয়।

আমাদের মনের যত্ন নিতে হবে। সব থেকে বেশি যা দরকার তা হলো, আমাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গাকে মজবুত করতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের নিজেদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। আজকের তরুণেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে। সেই কাজ তারা আজ থেকেই শুরু করতে পারে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। বন্ধুর পাশে বন্ধু হয়ে বন্ধুর হতাশার কালো মেঘকে তারুণ্যের শক্তি দিয়ে কেবল তরুণেরাই পরাজিত করতে পারে। 

তরুণদের বলছি, জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আমরা চাই আমাদের এই দুঃখ গাঁথার ইতি ঘটুক।

সরকার ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েছে। আশা করি এবার আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণেরা তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা জীবনে ফিরতে পারবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মুখরতার সাথে সাথে আমাদের জাতীয় জীবনে সুদিন ফিরুক-এই প্রত্যাশা করছি।

শান্তা তাওহিদা ।।  চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়