ছবি : সংগৃহীত

রাজ দরবারে গিয়ে যথারীতি নিয়ম মেনে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ঋষি সুনাক। ব্রিটেনের ইতিহাসে এই প্রথম দেশ চালানোর দায়িত্ব নিলেন এক অভিবাসী সন্তান। লিজ ট্রাসের ইস্তফার পর থেকে সুনাকের নাম ছিল সব আলোচনায়। সেই জল্পনাই সত্যি হলো।

পার্টিগেট কাণ্ডে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়া বরিস জনসন সরকার থেকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সুনাক পদত্যাগ করতেই পড়ে যায় সেই বরিস জনসন সরকার। শুরু হয় নতুন প্রধানমন্ত্রীর খোঁজ। মাত্র সাত সপ্তাহ আগেই সেই লড়াইতে লিজ ট্রাসের কাছে হেরে গিয়েছিলেন ঋষি। কিন্তু, শেষ হাসি হাসলেন তিনিই।

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইস্তফা দেন ট্রাস। তারপর থেকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে পাল্লা ভারী ছিল সুনাকেরই। তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত কি না তা নিয়ে ভারতে বা উপমহাদেশে উল্লাস থাকলেও তার মগজে ব্রিটেনের স্বার্থের বাইরে কিছুই নেই এবং আমরা নিশ্চিত যে তার কাজকর্মেও সেটাই দৃশ্যমান হবে।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক মন্দা ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি 

বাংলাদেশের ভেতরও ঋষি সুনাককে নিয়ে আলোচনা কম নয় এবং এর একটি বড় কারণ যে, এই প্রথম একজন উপমহাদেশীয় ব্যক্তি এই পদে বসেছেন। দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের পরের বাড়িটি অর্থাৎ ১১-তে তিনি ছিলেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এবং এবার সেই দশেই উঠে এলেন রাজকীয় ব্রিটেনের অ-শ্বেতাঙ্গ সরকার প্রধান হিসেবে। 

সুনাক নিয়ে আমাদের আলোচনার শেষ নেই। সেখানে অদ্ভুত সব কথা সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। কেউ বলছেন, উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধ মধুর প্রতিশোধ...

সুনাকের এই পদে উঠে আসা নিয়ে অনেক কথা আছে, ব্রিটেনে সরকার টিকছে না, বারবার প্রধানমন্ত্রী বদল হচ্ছে এবং সর্বশেষ লিজ ট্রাস মাত্র ছয় সপ্তাহ কোনো রকমে টিকেছেন। একথা ঠিক যে, দেশের অর্থনীতি পর্যদুস্ত অবস্থায় আছে, কিন্তু যে বিষয়টি আমাদের আলোচনায় আসছে না, তা হলো সুনাকের ঘটনা সেই ব্রিটেনকেই প্রতিনিধিত্ব করছে যে এখনো বিকশিত হচ্ছে বহুত্ববাদের পথে, বহুসংস্কৃতি ও বর্ণের সমাজ গঠনে।

সুনাক নিয়ে আমাদের আলোচনার শেষ নেই। সেখানে অদ্ভুত সব কথা সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। কেউ বলছেন, উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধ মধুর প্রতিশোধ। কেউবা এমন করে ট্রল করছেন যেন ব্রিটেন এক গভীর খাদে পড়ে গেছে। যারা এমনটা করেছেন তারা বুঝতে পারছেন না যে, গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই এটি, দলের ভেতর কতটা গণতন্ত্র চর্চা হলে দল প্রধানের সমালোচনা করা যায়, সংসদে স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে সরকার বদলানো যায়।

আমাদের এখানে সংবিধানে থাকা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলীয় সংসদ সদস্যরা কেবল জ্বি জ্বি হুজুর করেন সংসদে, কোনো জন-গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনগণের পক্ষে দলের বাইরে ভোট দিতে পারেন না।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক খাদ্যসংকট ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

ঋষি সুনাককে নিয়ে ভারতে উল্লাস বেশি। অথচ তাদের জন্যই শিক্ষা এই যে, মানুষকে তার ধর্ম বা আদি পরিচয় দিয়ে বিচার করলে কোনোদিনই তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রধান হতে পারতেন না।

বাংলাদেশেও মানুষের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে উন্মাদনা আছে, আদি পরিচয় অস্বীকার করার প্রবণতা আছে। পাকিস্তানে আরও বেশি আছে এসব বিদ্বেষ চর্চা।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েই পুরোনো একঝাঁক মন্ত্রীকে ছাঁটাই করলেন ঋষি সুনাক। পাশাপাশি, পূর্বসূরি লিজ ট্রাসের জমানায় বাদ পড়া এবং ইস্তফা দেওয়া কয়েকজন রক্ষণশীল নেতা-নেত্রীকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়েছেন তিনি।

দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন তার মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে লাইনে ফিরিয়ে আনা। অর্থনীতিকে লাইনে ফেরাতে কড়া পদক্ষেপের পথে হাঁটবেন বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে এবং সেই পথে তিনি প্রথমেই বর্তমান মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য সরিয়ে দিতে পিছপা হননি।

সুনাকের মন্ত্রিসভায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ হয়েছে ডমিনিক রাব, জেরেমি হান্ট এবং সুয়েলা ব্রেভারম্যান। উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হয়েছে রাবকে। হান্ট বহাল রয়েছেন অর্থমন্ত্রী হিসেবেই। আর ট্রাস মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফার এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রেভারম্যান আবারও ফিরে এসেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে। এবং হান্টের মতোই প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে পদে বহাল থাকলেন বেন ওয়ালেস। হাউস অব কমন্সের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে সরে যাওয়া পেনি মরডান্ট। 

ঋষি সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভূত কি না তা নিয়ে ভারতে বা উপমহাদেশে উল্লাস থাকলেও তার মগজে ব্রিটেনের স্বার্থের বাইরে কিছুই নেই এবং আমরা নিশ্চিত যে তার কাজকর্মেও সেটাই দৃশ্যমান হবে।

সুনাক মুনি ঋষি নন। তাই সেই পথে কোনোকিছুর সমাধানও তার হাতে নেই। তীব্র জ্বালানি সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে দিশাহীন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির সঙ্গে তাকে সামাল দিতে হবে চরম বিভক্ত একটি রাজনৈতিক দলকে।

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িতে ঢোকার আগে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, সহানুভূতির সঙ্গেই দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মোকাবিলা করবেন তিনি। বলতে দ্বিধা করেননি যে, তার পূর্বসূরি বেশকিছু ভুলভ্রান্তি করেছেন। সেগুলো শোধরানোর কাজ তাকে করতে হবে।

আরও পড়ুন : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কী? 

কোভিড-১৯ মহামারির সময় অর্থনীতি দেখভালের দায়িত্বে থাকা, বিপুল পরিমাণ সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সহায়তা করে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিলেন ঋষি। এখন তার একটাই কাজ, দলে ও অর্থনীতিতে বিরাজমান অস্থিরতা নিরসন করা। মুখের কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে তাকে।

চলতি বছরই ট্রাসের সঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের লড়াইয়ে নামার সময় তিনি যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হাজির করেছিলেন এখন সেটাকেই সামনে আনবেন তিনি। সুনাক ট্রাসের কর হ্রাস ও ধার করে প্রতিদিনের ব্যয় সামলানোর পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছিলেন; বলেছিলেন, ওই পরিকল্পনা অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে।

দেড় মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ট্রাসের আমলে পাউন্ডের দর কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে নিচে চলে যায়, বন্ডের দাম ধসে পড়ে, ব্রিটিশ অর্থনীতি হাবুডুবু খেতে থাকে তুমুল অস্থিরতার মধ্যে। ঋষি নিজে যা চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন। দেখা যাক তার হাত ধরে ব্রিটেন কী পায়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন