ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চললেও প্রশাসন বরাবরই নির্বিকার। কেন তারা নির্বিকার তা পরিষ্কার নয়। হয়তো তাদের কিছুই করার নেই অথবা তারা অযোগ্য। তাও আসলে আমাদের অজানা।

একটি দেশের দুই-তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং যদি ১০ বছরে ১০৮-৩০০ এর মধ্যে চলে যায় তাহলে সেই দেশটি নিঃসন্দেহে উন্নতির সিঁড়িতে আছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং-এর উন্নতির সাথে দেশের মানুষ তথা দেশের উন্নতির একটা দারুণ মেলবন্ধন আছে। ঠিক এটিই ঘটছে সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে।

আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক? 

২০১৭ সাল থেকে সৌদিতে নারীরা গাড়ি চালাতে পারে, মাঠে খেলা দেখতে যেতে পারে, সিনেমা দেখতে যেতে পারে, এক সময় যা ছিল অকল্পনীয়। এগুলোর জন্য সৌদি নারী অ্যাক্টিভিস্টদের অনেক আন্দোলন করতে হয়েছে।

সৌদি আরবে এখন ৫৬টি সিনেমা হলে ৫১৮টি স্ক্রিন আছে যেখানে এই পর্যন্ত ১১১৫টি সিনেমা দর্শকদের দেখানো হয়েছে। বেশিদিন হয়নি যে সৌদি নারীরা বাবা, স্বামী, ভাই বা পরিবারের কেউ ছাড়া হজ পর্যন্ত করতে পারতো না, এখন পারে কিন্তু এখনো একা না। কোনো একটি দলে যোগ দিয়ে পরিবারের সদস্য ছাড়াও এখন নারীরা হজ করতে পারে। এটাই অনেকে বিশাল প্রাপ্তি হিসেবে দেখছে। 

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে যেই দেশের কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, আছে অশিক্ষিত বেকার মানুষের বোঝা, সেই দেশের মানসম্মত শিক্ষাই হতে পারে সবচেয়ে বড় সম্পদ।

২০১৯ সালের আগে রেস্টুরেন্টে নারী-পুরুষের আলাদা বসার ব্যবস্থা ছিল। ২০১৩ সালে নারীদের আবাসিক এলাকায় সাইকেল এবং মোটরবাইক চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়। শিক্ষা যত আগাবে এইসব পরিবর্তন ততই দ্রুত আসবে। তাই বোঝা যাচ্ছে শিক্ষার সাথে নারী স্বাধীনতার একটা সম্পর্ক আছে।  

শুধুই কি সৌদি আরব? সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেইগুলোর ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং হলো ১৮৩, ২৮৮ এবং ৩৮৩! এছাড়া ৬০০-৭০০ এর মধ্যে আরও ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এমনকি আর দুবাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় কসমোপলিটান শহরে পরিণত হয়েছে।

২০ বছরে এই শহরের বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বের অনেক নামীদামি কোম্পানি ও মিডিয়া সেন্টারের শাখা অথবা হেড অফিস হয়েছে। বিদেশিরা অনেকটাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে।

ছোট্ট একটি দেশ কাতার। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং হলো ২২৪! একই কথা বলা চলে ইরানের ক্ষেত্রে। ইরানের লেখাপড়ার মান অনেক ভালো। যদিও মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়েছে সঠিকভাবে হিজাব না পরার কারণে। এই সময়ে এসে পোশাকের কারণে মানুষকে মেরে ফেলা বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আরও পড়ুন : মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষা : সংকট ও করণীয় 

মাহসা আমিনির মৃত্যুকে ঘিরে এখনো উত্তাল ইরান। শিক্ষার মান যদি খারাপ হতো এই মানের এবং এত সৃষ্টিশীল প্রতিবাদ হতো না। এই জন্যই বিশ্বের যত খারাপ শাসক আছে তারা শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে চায় না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের অবস্থার দিকে তাকাই। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৩৬৫তম অবস্থানে; ২০১০ সালে ঢাবি ও বুয়েট ৫৫০-৬০০-এর মধ্যে ছিল; ২০১২ সালে ছিল ৬০১-৭০০-এর মধ্যে; ২০১৪ সালে আরও পিছিয়ে ছিল ৭০১-৮০০-এর মধ্যে।

২০২২ সালে র‍্যাঙ্কিং-এ ঢাবির স্থান হয়েছে ৮০১-১০০০-এর মধ্যে। এর সাথে দেশের অবস্থা, দেশের নারীদের অবস্থা, দুর্নীতির অবস্থা একটু পরখ করলেই টের পাবেন সবকিছুই ধাপে ধাপে পেছাচ্ছে।

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে যেই দেশের কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, আছে অশিক্ষিত বেকার মানুষের বোঝা, সেই দেশের মানসম্মত শিক্ষাই হতে পারে সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিন্তু তার জন্য শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। এইটা যথেষ্ট না তবুও এটা দিয়ে শুরু হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিংয়ের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র গবেষণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র গবেষণার মান যে খুব অনুন্নত তা সবাই জানেন। এই মান বাড়ানো বা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের প্রশাসনের কোনো আগ্রহ নেই। এতেই বোঝা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কেন পিছিয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশে তো বিজ্ঞানে জাতীয় পর্যায়ে বড় কোনো পুরস্কারই নেই। ভারতে একটি বড় পুরস্কার হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার (এসএসবি) [Shanti Swarup Bhatnagar Prize]। ব্যক্তিগতভাবে আমার জানাশোনা অন্তত দুইজন আছেন যারা এই পুরস্কার পেয়েছেন।

আরও পড়ুন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে

আমাদের দেশে পুরস্কার থাকলেও সেটা এতটাই দলীয় রাজনীতির মোড়কে আবৃত যে, যেই দল ক্ষমতায় সেই দলের বিজ্ঞানী ছাড়া অন্য কেউ এইসব পুরস্কার পান না। শান্তি স্বরূপ ভাটনগর (এসএসবি) পর্যায়ের কোনো পুরস্কার বাংলাদেশে এখনো চালুই হয়নি।

একটা দেশের সরকার সেই দেশের শিক্ষা এবং বিশেষ করে বিজ্ঞানে কতটা গুরুত্ব দেয় সেটাও সেই সরকারের মান নির্দেশ করে। বর্তমান সরকার বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তি বসিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানহীন প্রযুক্তি শিখলে আমরা কেবল প্রযুক্তির ভোক্তা হতে পারব। বিজ্ঞানী আর হতে পারব না।

আমাদের দাতা বা মুনিবরা নিশ্চয়ই সেটাই চায়। সফল হলে কোটি মানুষের বিশাল ভোক্তা বাজার পাবে। বর্তমান সরকার কিংবা এর আগের সরকার অথবা তারও আগের সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি যা, শিক্ষার পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য। তাই ক্ষমতায় বিএনপি আসলো না আওয়ামীলীগ আসলো বা অন্যদল, শিক্ষা ও গবেষণায় কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। 

আমাদের দেশে পুরস্কার থাকলেও সেটা এতটাই দলীয় রাজনীতির মোড়কে আবৃত যে, যেই দল ক্ষমতায় সেই দলের বিজ্ঞানী ছাড়া অন্য কেউ এইসব পুরস্কার পান না।

আমাদের দেশে দরকার নতুন আইডিয়া। শিক্ষা নিয়ে নতুন চিন্তা ভাবনার আধুনিক দল। আধুনিক দল মানে যারা দেশকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখবে। শিক্ষা, গবেষণা নিয়ে আলাদা করে চিন্তা করবে। যারা বিদেশে দলের শাখা প্রশাখা খুলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে না। যারা দেশের শিক্ষার মর্ম বুঝবে।

প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ। এই মানুষ সম্পদও হতে পারে আবার বোঝাও হতে পারে। সঠিক মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত করতে পারলে এর চেয়ে বড় সম্পদ আর হতে পারে না।

আমরা কেমন মানুষ তৈরি করছি সেটা যেকোনো সরকারি অফিস, সরকারি ব্যাংক, রাস্তা, বিমানবন্দর এমনকি ফেসবুক পেইজ ইত্যাদির যেকোনো একটিতে গেলেই বুঝতে পারব।

আরও পড়ুন : আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?

বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মানের দিকে নজর নেই। মনে হচ্ছে সংখ্যাই যেন সবকিছু। মান স্থূল।

শিক্ষা, গবেষণা নিয়ে আমাদের করার মতো অনেক কাজ আছে। সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। শুধু বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে সেই বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত মান, বিজ্ঞান ল্যাব, গবেষণাগার প্রস্তুত করতে হবে। তার পাশাপাশি বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা প্রধান শিক্ষক বা ভিসি হবেন তারাও যেন প্রগতিশীল মানসিকতার হয়। তারা যদি গোঁড়া মানসিকতার হয় তবে শিক্ষা তো দূরের কথা কোনো গবেষণাই কাজে দেবে না।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়