ছবি : সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের একটি সংলাপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সংলাপটি হলো ‘খেলা হবে’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দারুণ জনপ্রিয় এই সংলাপ। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদরাও লুফে নিয়েছেন সংলাপটি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কয়েকদিন আগে বিরোধী দল বিএনপির উদ্দেশে ‘খেলা হবে’ বলে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। বিএনপিও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ‘খেলা হবে’ বলে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। রাজনীতি আসলেই একটি খেলার মতোই। তবে খেলার যেমন কিছু নিয়মকানুন আছে, রাজনীতিরও আছে।

প্রথম কথা হলো, খেলার জন্য একটি সমতল মাঠ দরকার। মানে হলো, সব দল খেলার জন্য সমান সুবিধা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ মোটেই সমতল নয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময়ই বাড়তি সুবিধা পান। কারণ তাদের সাথে দলীয় নেতাকর্মীরা তো থাকেই; থাকে পুলিশ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র। এটা ঠিক খেলায়ও স্বাগতিকেরা কিছু সুবিধা পায়।

আরও পড়ুন : কোন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছে তারা? 

ক্রিকেট মাঠে নিজেদের বোলিং শক্তি বিবেচনায় স্বাগতিকেরা সুবিধামতো পিচ বানায়। তাছাড়া গ্যালারি ভর্তি নিজেদের দর্শক সমর্থন তো আছেই। তবে হোম অ্যাডভান্টেজেরও একটা সীমা থাকে। সীমা অতিক্রম করলে আর খেলা হয় না, একতরফা হয়ে যায় সবকিছু। বাংলাদেশের রাজনীতির খেলায়ও নিয়মকানুনের বালাই নেই, সবকিছু হচ্ছে একতরফা।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে সেটা নিছক কাগজে-কলমেই। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সরকারের পোষমানা। মাঠের বিরোধী দলকেও সরকার মামলা দিয়ে, হামলা করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে। তবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ মোটেই সমতল নয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময়ই বাড়তি সুবিধা পান। কারণ তাদের সাথে দলীয় নেতাকর্মীরা তো থাকেই; থাকে পুলিশ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্র...

নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে নামলেও বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাদের আন্দোলন মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য। বিএনপি আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দাবি আদায় করতে পারবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকার বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের আছে।

বিএনপি লোডশেডিং, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশ করছে। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের সমাবেশ দিয়ে শুরু হওয়া বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি শেষ হবে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ দিয়ে। এই পর্যন্ত তিনটি সমাবেশ করেছে বিএনপি। চট্টগ্রামের পর ময়মনসিংহ ও ২২ অক্টোবর বহুল আলোচিত খুলনার সমাবেশ শেষ হয়েছে।

আরও পড়ুন : সহিংসতার জন্য রাজনীতি নাকি রাজনীতির জন্য সহিংসতা? 

সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ বিএনপিও কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই সমাবেশ করছে।

চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনায় বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাবেশ করেছে। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সরকার ও সরকারি দলের কৌশল খেলার নিয়মকানুনের ধার ধারেনি। চট্টগ্রামের সমাবেশ বিএনপি প্রায় বিনা বাধায় করতে পেরেছিল। আমার ধারণা সরকার দেখতে চেয়েছিল বিএনপির জনপ্রিয়তা। তাই চট্টগ্রামের সমাবেশ মোটামুটি বিনা বাধায় করতে পারলেও ময়মনসিংহ থেকেই বিএনপির সমাবেশে লোক সমাগম ঠেকানোর কৌশল নিয়ে মাঠে নামে সরকারি দল।

তবে খুলনায় এসে সরকারি দল সকল নিয়মকানুন ভেঙে মাঠে নেমেছে। খেলায় যেমন কৌশল আছে, রাজনীতিতেও আছে। কিন্তু খুলনায় সরকারি দল যা করেছে, তা নিছক কৌশল নয়। এটাকে অপকৌশলও বলা ঠিক হবে না, এটা আসলে কূটকৌশল।

আরও পড়ুন : রাজনীতি কি মরণ খেলা? 

সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ—সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। তবে সেটা নিছক কাগজে-কলমেই। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সরকারের পোষমানা...

বিএনপির সমাবেশ ঘিরে ২০ অক্টোবর থেকে বৃহত্তর খুলনার মানুষের অবাধ চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম ঠেকাতে সরকার কূটকৌশলে খুলনাকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সরকার বিএনপির সমাবেশে বাধা দিচ্ছে না। তর্কের খাতিরে এটাকে সত্য মনে হতে পারে। কারণ সরকার তো সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বিএনপির সমাবেশের সময়ই পরিবহন মালিকেরা ধর্মঘট ডাকেন, তখন সরকারের দাবি কেউ বিশ্বাস করে না। শুধু সড়ক পথ নয়, নৌপথেও ধর্মঘট চলছে। বন্ধ রয়েছে খেয়া পারাপারও।

আরও পড়ুন : বিএনপি চা খেতে যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 

সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, পরিবহন ধর্মঘটের ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবাধ চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার যারা বিঘ্নিত করছে, তাদের ব্যাপারে সরকারের কিছু করার থাকবে না কেন। যারা সাধারণ মানুষের চলাফেরার বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি; যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে বা নাশকতা করতে পারে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা যাই বলুন, সাধারণ মানুষ জানে এই পরিবহন ধর্মঘটও সরকারের ইশারায় হচ্ছে, গ্রেপ্তারও ভয় দেখাতেই হয়েছে। কিন্তু এভাবে যে সমাবেশ ঠেকানো যায় না, সেটা এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে।

সরকারের কূটকৌশলের কারণে বৃহত্তর খুলনার লাখ লাখ মানুষ যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়লো, তার দায়ও সরকারকেই নিতে হবে।

আরও পড়ুন : বিএনপির লবিং এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ 

শুরুতেই বলছিলাম খেলার কথা। খেলতে হবে নিয়ম মেনে। ফাউল যেমন খেলার অংশ, লাল কার্ডও খেলারই অংশ। সরকার যদি একতরফা খেলতে চায়, কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে হারাতে চায়, তাহলে জনগণ সেটা মানবে না।

একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই। বিএনপি এক লাখ লোকের সমাবেশ করলে আওয়ামী লীগ দুই লাখ লোকের সমাবেশ করে তার জবাব দিতে পারে। প্রতিপক্ষের সমাবেশ লোক আসতে বাধা দেওয়া কোনো রাজনীতি নয়, খেলাও নয়।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ