বাংলাদেশের ডেঙ্গু ইতিহাসে ভিন্নধর্মী একটি চিত্র আমরা দেখতে পেলাম ২০২২ সালে। সরকারি হিসাব মতে এই বছর অক্টোবর মাসে প্রায় ২১,৯৩২ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৮৬ জন মারা গেছে। নভেম্বরেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০২২ সাল মৃত্যুতে ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে গেল।

২০১৯ সালে এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেও অক্টোবরে আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ৮,১৪৩ জন এবং কেউ মারা যায়নি। ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে তবে অক্টোবর-নভেম্বরে এরকম ভয়াবহতা এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন?

অক্টোবর-নভেম্বরে ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রভাব এখানে রয়েছে।  শুধুমাত্র বাংলাদেশেই যে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি তা নয়।

পৃথিবীর অন্যান্য কিছু দেশ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, ভিয়েতনামে এই সময় ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করেছি।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তিত হয়েছে। অক্টোবরেও থেমে থেমে বৃষ্টি, উপযোগী তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা এডিস মশার ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে এবং ডেঙ্গু ছড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।

মে মাসে যখন ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হলো তখন সঠিকভাবে এডিস মশা এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে এটি জ্যামিতিক হারে বেড়ে বর্তমানে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এডিস মশার প্রজনন স্থল তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বছর মে মাসে যখন ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হলো তখন সঠিকভাবে এডিস মশা এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে এটি জ্যামিতিক হারে বেড়ে বর্তমানে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ। মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটি করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, সাবধানতা ও সচেতনতা 

ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা ও ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে সাধারণ জনগণেরও রয়েছে। সকলে যার যার অবস্থান থেকে নিজের দায়িত্বটুকু যদি সঠিকভাবে পালন করতে পারে তাহলে এই রোগ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেটি আমাদের পার্শ্ববর্তী শহর কলকাতা করে দেখিয়েছে।

৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে ৪৩ হাজারের অধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৭০ জন মারা গেছে। কিন্তু ভারত এত বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের আক্রান্ত সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। সেখানে কলকাতায় সারা বছরে আক্রান্ত প্রায় ৩ হাজার। অক্টোবরে ভারতে গিয়ে দেখলাম কলকাতায় সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করেছে।

আমরা বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এই কয়টি বিষয় মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি, তাতে দেখা যাচ্ছে খুব সহসাই ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি হবে হবে না। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে তবে তা অন্যান্য বছরের মতো কমবে না।

ঢাকা শহরে এখন ডেঙ্গু সারাবছরই বিদ্যমান থাকবে। ঢাকাতে এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা সারা বছরই বিদ্যমান।

ঢাকা শহরে এখন ডেঙ্গু সারাবছরই বিদ্যমান থাকবে। ঢাকাতে এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা সারা বছরই বিদ্যমান।

আমরা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করতে গিয়ে ঢাকা শহরে কিছু কিছু প্রজনন স্থল, বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি, বড় ভবনগুলোর নিচে পার্কিং-এ গাড়ি ধোয়ার স্থান, প্রতিটি বাড়িতে ওয়াসার মিটার সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা চৌবাচ্চায় জমে থাকা পানি, এবং পানির স্বল্পতার কারণে ড্রাম এবং বালতিতে জমিয়ে রাখা পানিতে আমরা সারা বছরই এডিস মশা পাচ্ছি।

এই পাত্রগুলো তৈরি হওয়ার জন্য বৃষ্টিপাতের কোনো প্রয়োজন নেই। যার যার অবস্থান থেকে নগরবাসী যদি এই পাত্রগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার করতে পারে তাহলে ডেঙ্গু অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

ডেঙ্গু যেহেতু সারা বছরই থাকবে তাই সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ এডিস মশার জন্য আলাদাভাবে সারাবছর চালাতে হবে সঙ্গে সঙ্গে নগরবাসীদের নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনোভাবেই এডিস মশার প্রজনন তার বাড়িতে না হয়।

কোনো বাড়িতে বা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী থাকলে তাকে অবশ্যই মশারির ভেতরে রাখা উচিত যেন তার মাধ্যমে অন্য কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত না হয়। যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্যটুকু সঠিকভাবে পালন করলে ডেঙ্গু সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি সম্ভব।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com