ছবি : সংগৃহীত

শেখ ফজলে শামস পরশ যখন যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে উচ্চারিত হলেন তখন সেই যুবলীগের ওপরে যেন স্বস্তির পরশ বয়ে গেল। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে নানাবিধ অভিযোগ-অনুযোগ সবকিছু মিলিয়ে যুবলীগ, আওয়ামী লীগের উপরে যেন একটি বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।

শেখ পরশের দায়িত্ব নেওয়ার আগে যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে ক্রমাগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, ক্যাডার ভিত্তিক রাজনীতি সর্বোপরি ক্যাসিনো এবং জুয়া বিস্তারের ব্যাপক অভিযোগ ছিল।

সব মিলিয়ে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির যুবলীগকে কলঙ্কিত করার প্রতিটা ধাপ যেন ঠাণ্ডা মাথায় সাজানো হয়েছিল। কথিত আছে যুবলীগের এক নেতা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও চাঁদা দাবি করেছিল। ঠিক তখনই নড়ে বসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যুবলীগকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলার পদক্ষেপ নেয়। শুরু হয় যুবলীগের নতুন বিপ্লব। আমাদের সামনে আবির্ভূত হন শেখ মনির বড় সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ।

আরও পড়ুন : যুবলীগের যে ধরনের রাজনীতি করে 

তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে শেখ পরশের পরিচিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। সংগীতে যার প্রবল যোগ, কাব্যে যার তীব্র অনুরাগ আর তরুণদের পড়াতে যিনি ভালোবাসেন আর বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। এমন এক অধ্যাপক যুবলীগের দায়িত্ব নেওয়ায় অনেকেই নড়ে চড়ে বসেন।

চারদিকে শুরু হয় আলাপ, বলা হতে থাকে এ কোনো যুবলীগ। শেখ পরশ যুবলীগের দায়িত্ব নিয়েই রাতারাতি এর খোলনলচে পাল্টে ফেলতে থাকেন। যুবলীগের যত বিতর্কিত নেতা, উপনেতা, গুচ্ছনেতা, উপগুচ্ছ নেতা কিংবা উটকো কমিটি রয়েছে তার প্রতিটিই বিলুপ্ত করতে থাকেন এবং শুরু করেন শুদ্ধি অভিযান। 

যুবলীগের নতুন কমিটির গল্পটা অনেকটা বিস্ময়ে ভরা। দেশের সমস্ত চৌকস আর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের যেন এক মিলন মেলা ছিল এটি....

দ্রুত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় এবং শেখ পরশের সাথে আবির্ভূত হন চৌকস মইনুল হোসেন খান নিখিল যিনি আওয়ামী লীগের আরেক পরীক্ষিত নেতা।

যুবলীগের নতুন কমিটির গল্পটা অনেকটা বিস্ময়ে ভরা। দেশের সমস্ত চৌকস আর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের যেন এক মিলন মেলা ছিল এটি।

ব্যারিস্টার তৌফিকুর রহমান, ব্যারিস্টার শেখ নাইম, ফরিদপুরের জনপ্রিয় নেতা নিক্সন চৌধুরী, সাবেক তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা জয়দেব নন্দী, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন...কে ছিল না এই কমিটিতে।

আরও পড়ুন : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস 

সাধারণের ভেতর যেই দুটো স্বস্তি কাজ করে এই কমিটিতে সেটি হচ্ছে, (১) উচ্চ ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ হাল ধরেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই শাখা সংগঠনের, (২) এক নব বিপ্লবের পথে যুবলীগ।

শেখ পরশ যুবলীগে চালু করেন ‘সিভি ড্রপ’ পদ্ধতি। অর্থাৎ যিনি যুবলীগের পদ চাইবেন তাদের জীবন বৃত্তান্ত দিতে হবে সংগঠনে, কেন তারা এই জনপ্রিয় সংগঠনে যোগ দিতে চান তারও ব্যাখ্যা দিতে হবে সেখানে।

বাংলাদেশের একটি মূল রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠনে ঢোকার জন্য এই ‘সিভি ড্রপ’ পদ্ধতি এক রাতেই যেন আমূল পাল্টে দেয় এর কাঠামো। ঝরে পড়তে থাকে অথর্বরা, ঝরে পড়তে থাকে সুবিধাভোগী কিংবা অশিক্ষিত সব অপ্রাসঙ্গিক নেতা নামের কলঙ্ক।

কেননা সিভিতে তো শেষ পর্যন্ত লেখা যায় না, ‘আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই’। ফলে যুবলীগ এই নতুন প্রক্রিয়ায় তীব্র আশার আলো দেখাতে থাকে দেশের দলমত নির্বিশেষে সব তরুণদের। একজন সংগীত ও কাব্য অনুরাগী অধ্যাপকের এই দ্রুত সিদ্ধান্ত লয় ফেরাতে থাকে যুবলীগের।

যুবলীগের ভেতর একধরনের প্রাণ ফিরে পেতেই এর প্রাণ প্রাচুর্য দেখবার একটা প্রয়োজন হয়। নতুন কাঠামোর যুবলীগ ঠিক মাঠের রাজনীতিতে কতটা ক্রিয়াশীল তা জানারও কৌতূহল হয় সকলের। যেই শেখ মনি এই দেশের যুব রাজনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা তারই ছেলে যখন দলের দায়িত্ব নেন এত বছর পরে তখন তার পরিবর্তন ও নীতি কাঠামোর সামর্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ! 

মৌলবাদী দল হেফাজতে ইসলাম যখন প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য নিয়ে তুমুল নোংরা ও অসভ্যতার সূচনা করেছিল এবং অনেকটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তারা বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে ঠিক তখনই আমরা রাজপথে নামতে দেখি যুবলীগকে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে সামিল হয় বাংলাদেশ যুবলীগ এবং প্রথম সারির নেতা থেকে শুরু করে সব নেতারাই নেমে আসেন রাজপথে এবং শুরু করেন প্রতিবাদ।

এই প্রতিবাদের আগে ঠিক কবে বা কখন যুবলীগ এইভাবে এত তীব্রতা নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল, আমাদের আসলেই জানা নেই। যুবলীগের কাজ আসলে কী, কিংবা কী করতে চায় এটিও ছিল অজানা। এক অধ্যাপক যেন রাতারাতি যুবলীগকে একটি অর্থবহ সংগঠনের ইমেজ এনে দেয় এই জনপদে। 

এই প্রতিবাদের আগে ঠিক কবে বা কখন যুবলীগ এইভাবে এত তীব্রতা নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল, আমাদের আসলেই জানা নেই...

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী মোর্চাদের বিরুদ্ধে যুবলীগের এই হুংকারে পিছু হটে কাগুজে বাঘ হেফাজতে ইসলাম, চরমোনাইসহ সব মৌলবাদী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। যুবলীগ জানান দেয় তারা আছে আমাদের পাশেই।

যেই ভাস্কর্যকেন্দ্রিক প্রতিবাদ দিয়ে যুবলীগের তীব্রতার শুরু তার রেশ এখনো চলছে। এই যুবলীগ থেকেই ঘোষণা এসেছে ডিসেম্বর থেকে দেশ অচল করার বিরুদ্ধে স্রোতের হুমকির বিরুদ্ধে যুবলীগ থাকবে দেশের রাজনীতিতে, যুবলীগ থাকবে রাজপথে। আগুন সন্ত্রাসীদের ‘শ্যালো’ হুমকির বিরুদ্ধে যুবলীগের এই সাহসী প্রত্যয় জনসাধরণের ভেতর যে ভাবনার সঞ্চার জাগায় তা হচ্ছে, একটি শিক্ষিত, উজ্জীবিত, তারুণ্যে ভরা সংগঠন সব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শক্ত হাল ধরে রয়েছে।

আরও পড়ুন : অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ 

যুবলীগের একটা বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে মেধা। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী তরুণদের একটা সম্মেলন স্থল হয়ে উঠেছে যুবলীগ। একজন তরুণ কিংবা তরুণী যখন তার সিভি তৈরি করেন এবং মাথায় রাখেন এই সিভি যাচাই হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং আরও তীব্র মেধার সাথে লড়াইতে তখন স্বাভাবিকভাবেই এখানে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

যেই সম্ভাবনায় জুয়া কিংবা ক্যাসিনো প্লেয়ারদের দৌরাত্ম্য নেই, যেই সম্ভাবনায় উটকো অপ্রধান ব্যক্তির জ্বলে উঠার সমস্ত চেষ্টা ব্যাহত ও পরাজিত হয়।

তাই বলা চলে যুবলীগ চলছে একদল শিক্ষিত মেধাবী তরুণদের পদচারণায়। যার হাল ধরেছেন এক অধ্যাপক; যিনি সংগীত ভালোবাসেন, কবিতা ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন শিক্ষাকে।

ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ।। আইনজীবী ও গবেষক