ছবি : সংগৃহীত

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছেন ঢাকাবাসী। জানুয়ারি মাসে রাজধানীর বায়ুমান দুর্যোগপূর্ণ ছিল মোট নয় দিন যা সাত বছরের হিসাব মতে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই শীতকালে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুর মান খারাপ থাকে। বায়ু দূষণের নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত প্রভাব আছে। দূষিত বায়ু নগরবাসীর জন্য কতটা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষকগণ এবং বাংলাদেশের বড় বড় গণমাধ্যমগুলোও তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা এবং রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই ঝুঁকি পরিত্রাণে সরকারি সংস্থা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কার্যকর তৎপরতা চোখে পড়ে না।

আরও পড়ুন >>> ঢাকার বায়ু দূষণ কমাতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ 

এই বিষয়ে জাপানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। আমার পিএইচডির কাজের সময় জাপানে যাই। ঢাকা শহরে সাধারণত আমরা একটি শার্ট একদিন পরলে দ্বিতীয় দিন তা গায়ে দিয়ে কোনো অফিশিয়াল কাজে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। কারণ একদিন শার্ট একদিন পরার পর শার্টের কলার এবং হাতায় কালো ময়লা জমে যায়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রথম সাত দিন জাপানে যেন সুন্দর করে কাটাতে পারি, তাই সাতটি শার্ট আয়রন করে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে রওনা দিলাম। জাপানে গিয়ে প্রথম দিন একটি শার্ট পরে বাসায় ফিরে দেখি শার্টে কোনোরকম পরিবর্তনই হয়নি। 

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই শীতকালে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুর মান খারাপ থাকে। বায়ু দূষণের নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত প্রভাব আছে।

সেই সাতটি শার্ট আমি ৩ মাস পরেছিলাম। তিন মাসেও সাতটি শার্ট ময়লা হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম জাপানের বায়ুর মান খুবই ভালো। বাতাসে ধুলাবালি, রোগ জীবাণু নেই বললেই চলে। যারা জাপান ভ্রমণ করেছেন তারা নিশ্চয়ই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন।

বায়ু দূষণ এবং বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার প্রতিদিন দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তারা তৈরি করে একিউআই (AQI) সূচক।

আরও পড়ুন >>> আধিপত্য নয়, বন্ধুত্ব করি প্রকৃতির সঙ্গে 

শুধুমাত্র আইকিউএয়ারই নয় অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান একিউআই সূচক প্রকাশ করে। একটি নির্দিষ্ট শহরের বায়ু কতটুকু দূষিত বা নির্মল, সেই সম্পর্কে তথ্য দেয় এবং কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।

একিউআই মান যত বেশি, বায়ু দূষণের মাত্রা তত বেশি এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি তত বেশি। উদাহরণস্বরূপ ৫০ বা তার নিচের একিউআই মান হলে সেটিকে ভালো এবং এই মান ৩০০-এর বেশি হলে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আইকিউএয়ারের তথ্যমতে ৪ ফেব্রুয়ারি দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকা ছিল ৫ নম্বরে। যদিও ঢাকাতে পেছনে ফেলে চীনের উহান ও চেংদু, ভারতের মুম্বাই এবং রাশিয়ার ক্রাসনোয়ারস্ক সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। টোকিও হচ্ছে জাপানের সবচেয়ে দূষিত শহর।

জাপানের এই দূষিত শহরেরও একিউআই মান ৪৫, যাকে ভালো বায়ু মানের শহর হিসেবে ধরা হয়। জাপানের অন্যান্য শহরের তো একিউআই মান আরও অনেক কম। শুধু জাপান নয় পৃথিবীর অনেক দেশেই বায়ু দূষণ রোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং সফল হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> প্লাস্টিক দূষণ : বাংলাদেশ কী করছে? 

প্রতিবছর শীতকালে খারাপ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ু দূষণ রোধে নির্দেশিকার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুইবার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেওয়া—কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি।

বায়ু দূষণ ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী অক্ষমতা এবং মৃত্যুর জন্য শীর্ষ ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ু শ্বাস নেওয়ার ফলে একজন ব্যক্তির হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে। মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। বায়ু দূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই।

যানবাহন ও শিল্প কারখানার ধোঁয়া, বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলায় আবর্জনা, কেরোসিন ও কাঠ-কয়লা দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ইটভাটা, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা ও চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। এগুলোর পাশাপাশি আন্তসীমান্ত বায়ু দূষণের জন্যও এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন >>> জলবায়ু পরিবর্তন বনাম ক্রিকেট : বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতখানি? 

ঢাকা শহরে যে যানবাহনগুলো চলে সেগুলো বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ীর সংখ্যাও কম নয়। গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়।

উন্নত দেশগুলোয় ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরোনো গাড়ি বাতিল করে দেয়। উন্নত দেশগুলো গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে এর সালফারের মাত্রা ৫০-এর নিচে আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর উপরে। তারা ভালো মানের জ্বালানি ব্যবহার করে। তারা ঠিকভাবে গাড়ির মেইনটেন্সেস করে, আমরা তা করি না। ফলে আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর দূষণ হয়। শুধু তাই নয়, বিকল্প যানবাহন দূষণ কমায়। ট্রাম বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। মেট্রোরেল ও ইলেকট্রিক কার দূষণ কমায়। 

বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে। বায়ু দূষণজনিত রোগে বাংলাদেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই।

বাংলাদেশে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। কাজে ব্যবহৃত মাল পত্র ঢেকে রাখা হয় না। উন্নত বিশ্বে নির্মাণ কাজ বিশেষ ভাবে ঢেকে এবং কম সময় নিয়ে করা হয়। এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় সারা বছর ধরে এবং মাটিগুলো রাস্তার পাশেই রাখা হয়। ওগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

এখানে গার্মেন্টস এবং শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায় ব্যাপকভাবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ঢাকার আশেপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেগুলো দূষণের জন্য কঠিনভাবে দায়ী। অনেক দেশে ইটভাটা নেই। তারা সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করে। আমরাও ব্লক ব্যবহার করতে পারি।

আরও পড়ুন >>> জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?

পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেহেতু বায়ু দূষণ কমাতে পেরেছে তাই বাংলাদেশের পক্ষেও এটি কমানো সম্ভব। এর জন্য আইন, পরিকল্পনা এবং সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

দরকার হলে পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে অভিযান পরিচালনা করা উচিত। তবে, শুধু স্থানীয়ভাবে ঢাকায় বায়ু দূষণ কমালে কাজ হবে না। এজন্য আন্তসীমান্ত বায়ু দূষণ বন্ধ করার বিষয়ে আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সকল দেশের একমত হতে হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বায়ু দূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য দুই দেশের সরকার প্রধানদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়