ছবি : সংগৃহীত

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনেই আর ইভিএম ব্যবহার করা হবে না, ৩০০ আসনের সবগুলোয় ভোটগ্রহণ হবে সনাতনী ব্যালট পেপার আর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে। 

নির্বাচন কমিশন থেকে এমন একটি ঘোষণা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করেনি, তবে কিছু বলতেও পারছে না। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করেছিল ইভিএমের।

কাজী হাবিবুল আওয়ালের কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে বসেছিল। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রচণ্ডভাবে ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নিলে সংসদের অর্ধেক আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা ধরে এগোচ্ছিল নির্বাচন কমিশন। তখন সরকার সমর্থিত বুদ্ধিজীবী মহলও ইভিএমের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে এবং কোনো কোনো পক্ষ ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহার করতে হবে বলে দাবি করেছিল।

আরও পড়ুন >>> ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি 

এখন সেই পরিকল্পনা বদলে গেল। দেড়শ আসনে যন্ত্রে ভোট করার পরিকল্পনার লক্ষ্যে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকায় ২ লাখ ইভিএম কেনার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থ সংকটের এই সময়ে সরকার এই টাকা দিতে সম্মত হলো না।

এই অবস্থায় কমিশনের হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ করে অন্তত ৫০-৮০টি আসনে ইভিএম ভোট করার সক্ষমতা ছিল ইসির। সেই লক্ষ্যে ইভিএম মেরামত ও ব্যবস্থাপনার জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল সরকারের কাছে। কিন্তু সেই চেষ্টাও সফল হয়নি।

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে নির্বাচনের বিরোধিতা যারা করেছিল তাদের মধ্যে বিএনপি ছাড়াও বেশকিছু নাগরিক সংগঠনও ছিল। তাদের যুক্তি ছিল যে, সাধারণ ভোটারকে ভরসা দিতে ভারতের মতো সবগুলো ভোটযন্ত্রে ভোটার-ভেরিফিয়াবল পেপার অডিট ট্রেইল (কাগুজে নথি) পদ্ধতি রাখতে হবে। ইভিএমে সমস্যা কোথায়, এমন প্রশ্ন করা হলে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। এর অন্যতম হলো হ্যাকিং করার আশঙ্কা।

যুক্তি বা শঙ্কা উড়িয়ে আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে শক্ত অবস্থানে ছিল। সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং বিতর্ক সব ছাপিয়ে বাস্তবতা হলো ইভিএমে নির্বাচন হচ্ছে না।

বিরোধীরা বলছেন, কোনো যন্ত্রই হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সুরক্ষিত নয়। আধুনিকতম কম্পিউটারের সুরক্ষাও সম্ভব হচ্ছে না। আরেকটি আশঙ্কা হলো ভোটের আগেই কারচুপির ফাঁদ ঢুকিয়ে রাখা হতে পারে এই যন্ত্রে।

এই সবগুলো যুক্তি বা শঙ্কা উড়িয়ে আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে শক্ত অবস্থানে ছিল। সন্দেহ, সংশয়, অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা এবং বিতর্ক সব ছাপিয়ে বাস্তবতা হলো ইভিএমে নির্বাচন হচ্ছে না।

আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি

বিএনপি কঠোরভাবে ইভিএমের সমালোচনা করেছে। বলতে হবে দলটির অলৌকিক বিজয় হয়েছে এই ক্ষেত্রে। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য কমিশনের সমানে যে মূল চ্যালেঞ্জ তা হলো নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ।

সব দল যেন ভোটে আসে, সেই পরিবেশ এখন তৈরি করতে হবে। কিন্তু সেই পরিবেশ কী হবে? এখন পর্যন্ত যে অবস্থা তাতে ইতিবাচক কিছু বলা যাচ্ছে না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বারবারই বলে আসছেন, সব দল ভোটে আনতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল—বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান বদলায়নি। বিএনপিসহ তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আনঢ় রয়েছে। অটল অবস্থানে আছে শাসক দল আওয়ামী লীগ যে, তাদের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।

২০২২ সালের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে হবে সেই নির্বাচন—এমন প্রত্যাশা দেশের পাশাপাশি বিদেশি পর্যবেক্ষক মহলেরও। কীভাবে তা হবে সেটাই প্রশ্ন।

বিএনপি বলছে এখন কাগজের ভোটেও তাদের আগ্রহ নেই। বিএনপি মনে করে, জাতির যে সংকট, সেই সংকট হচ্ছে—নির্বাচনকালীন সময়ে কোন সরকার থাকবে, কী ধরনের সরকার থাকবে সেটা। কিন্তু এই বিষয় কোনোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছে না যে, তত্ত্বাবধায়কই কী সংকটের সমাধান?

আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে 

বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাত বন্ধে তাৎক্ষণিক একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা-সংঘাতময় বাস্তবতার স্থায়ী সমাধান নয়।

অনেকেই বলেন যে, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনগুলোই বেশি সুষ্ঠু ছিল। হয়তোবা তাই। কিন্তু এতে কী আমাদের রাজনীতিতে অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাত কমেছে? সংসদ ঠিকভাবে চলেছে?

রাজনীতিকরা নিজেরা নিজেদের কতটা অবিশ্বাস করলে বা নিজেদের ভেতর আস্থাহীনতা থাকলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার গঠন করে তাদের দিয়ে নির্বাচন করতে চায়, সেটা একটা বড় ভাবনার বিষয়।

অনেকেই বলেন যে, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনগুলোই বেশি সুষ্ঠু ছিল। হয়তোবা তাই। কিন্তু এতে কী আমাদের রাজনীতিতে অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাত কমেছে? সংসদ ঠিকভাবে চলেছে?

প্রতিবার বিরোধী দল সংসদ বর্জন করছে। সরকার কী দায়বদ্ধতা দেখাতে পেরেছে জনগণের প্রতি? রাজনৈতিক দলগুলো কী সত্যিকারের মানুষের দল হয়েছে? কোনোটাই না।

আরও পড়ুন >>> ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি হওয়ার পূর্ণ নিশ্চয়তা আছে, এমন কথা তত্ত্বাধায়কের দাবি যারা করছেন তারাও বলবেন না।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন কাঠামোতে সমস্যা। ব্যক্তি ও পরিবার, গোষ্ঠী এবং সমাজ বিরোধীদের আধিক্য, দুর্নীতিই যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেখানে এসব আলোচনা অর্থহীন।

তবু দেশেও রাজনীতি থাকবে, রাজনৈতিক দল এবং নেতারাই দেশ পরিচালনা করবেন। সেই প্রেক্ষাপট থেকে ভাবনাটা রয়ে গেল, ইভিএম বিতর্কের অবসান হলো, কিন্তু নির্বাচনী বিতর্ক তো রয়েই গেল।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন