ছবি : সংগৃহীত

ব্যবসায়িক কাগজপত্র যত দেরিতে সরকারি নথিভুক্ত করা যায় ততই মঙ্গল, এটা বেশিরভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ধারণা। এমন ধারণার পেছনে কারণ কী! তারা নিশ্চয়ই জানেন ব্যবসায়িক কাগজপত্র ঠিকঠাক না থাকলে ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সরকারি সবরকম সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন!

সবাই জানেন, জেনেও তাদের এমন অনীহার কারণ হলো হয়রানি। এই হয়রানি রাষ্ট্রযন্ত্রের। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভ্যাট ও ট্যাক্স সংক্রান্ত হয়রানি। কিছুক্ষেত্রে সেই হয়রানি এত মারাত্মক হয়ে ওঠে যে প্রায়শই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবতে হয়।

ভ্যাট ও ট্যাক্সের কর্মকর্তারা উদ্যোক্তাদের আউটলেটে গিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে থাকেন এমন অভিযোগও উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আসে। আবার কোনো মেলা কিংবা এক্সিবিশনে অংশ নিলে সেখানে গিয়ে উদ্যোক্তাদের বেচাবিক্রির ফিরিস্তি নিয়ে চার্জ করার ঘটনাও অনেকের সাথেই ঘটেছে।

আরও পড়ুন >>> পূজার বাজার ও পূজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি 

ঘটমান বর্তমান এসব অসংগতির সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক আরেক প্রেক্ষাপট। ডিজিটাল বাণিজ্য আইন ২০২৩। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইভ্যালি, নিরাপদ ডট কম, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং বিডি, দালাল প্লাস, আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ ডট কম থেকে শুরু করে এমন আরও অসংখ্য ই-কমার্স কেলেঙ্কারির পর সরকারের টনক নড়েছে।

আর এরই প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি আইন করেছে, নাম ‘ডিজিটাল বাণিজ্য আইন-২০২৩’। যদিও এখন পর্যন্ত আইনটি খসড়া অবস্থায় আছে তারপরেও এর উত্তাপ গিয়ে লেগেছে উদ্যোক্তাদের শরীরে। এখানে বলা হয়েছে, পণ্য বিক্রি ও সেবাদাতা অনলাইন পেজ এবং ফেসবুকভিত্তিক সব ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা শুরুর আগে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি বা ডিবিআইডি (Digital Business Identification Number-DBID) নিবন্ধন নিতে হবে।

সারা দেশব্যাপী বিশাল ই-কমার্স বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে সিংহভাগ অবদান রাখবে ক্ষুদ্র ও তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা। যেখানে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের আলু-পটল চাষিও এই ই-কমার্স বাণিজ্যের সুবিধাভোগী হবেন।

এমনকি ‘ডিজিটাল আইন ২০২৩’ কার্যকর হওয়ার চার মাসের মধ্যে উদ্যোক্তাদের ডিবিআইডি নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর অন্যথা হলে অর্থাৎ নিবন্ধন না নিলে ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানির সঙ্গে তারা লেনদেন করতে পারবে না। উপরন্তু একে জেল জরিমানার মতো গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রচার করা হয়েছে।

এই যে সারা দেশব্যাপী বিশাল ই-কমার্স বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে সিংহভাগ অবদান রাখবে ক্ষুদ্র ও তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তারা। যেখানে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামের আলু-পটল চাষিও এই ই-কমার্স বাণিজ্যের সুবিধাভোগী হবেন।

আরও পড়ুন >>> ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অনলাইন ব্যবসার প্রসার 

নদীর চরে বাস করা যে নারীর উঠানে পাঁচটা দেশি মুরগি চড়ে বেড়ায় তিনিও অনায়াসে মুরগির ডিমের বাজার তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন এই ডিজিটাল বাজারে।

ডানে-বায়ে তাকালেও পয়সা খরচের যুগ এটা, সেখানে চাকরির পাশাপাশি বাড়তি উপার্জনের আশা কমবেশি আমরা সবাই করে থাকি। সুতরাং কোনো চাকরিজীবী যদি চান নিজের অবসর সময় কাজে লাগাতে সেক্ষেত্রে তিনিও যেন কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই সিজনাল ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন!

আসলে নীতিমালা প্রণয়কারীদের পুরো বিষয়টা ভাবতে হবে সহজ করে। ডিজিটাল বাণিজ্য আইন যেন কারও নাগরিক সুবিধা হরণ না করে। ই-কমার্স সেক্টরে নানারকম সমস্যা-সংকটের পর অবশ্যই একটা সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল তবে সেটা যদি হয় শুধুই কঠোর দমন নীতি তাহলে সরকারকে একটু থামতে হবে। আরও সময় নিয়ে সব শ্রেণির সুবিধাভোগীর জন্য ব্যবসাকে সহজ করার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে।

ই-কমার্সকে গতিশীল রাখতে ও সংশ্লিষ্ট নানাবিধ সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাত ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে পারে কেবলই সরকারের সঠিক বাণিজ্যনীতি। সঠিক শব্দটা উচ্চারণ করেছি এইকারণে যে ডিজিটাল আইনে শুধুই কঠোর দমননীতি দেখতে পাচ্ছি।

ধাপ ফেলা মাত্র উদ্যোক্তাদের পা আটকে যাবে এমন আইন কার্যকর করে ডিজিটাল বাণিজ্যখাতকে নিরাপদ ও সুরক্ষা দেওয়া যাবে না।  পাশাপাশি ভীতি সঞ্চারণ করে নয় বরং সঠিক উপস্থাপনার মাঝে যেকোনো আইনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। 

ই-কমার্সকে গতিশীল রাখতে ও সংশ্লিষ্ট নানাবিধ সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই খাত ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে পারে কেবলই সরকারের সঠিক বাণিজ্যনীতি।

নিবন্ধন ব্যতিরেকে জেল জরিমানা কিংবা ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না এমন ভীতিকর তথ্য প্রচারের কারণেই হোক কিংবা নিয়ম অনুসরণের উদ্দেশ্যেই হোক উদ্যোক্তারা ডিবিআইডি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার অংশ নিতে চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রক্রিয়াটা একেবারেই ইউজার ফ্রেন্ডলি না। সেখানে নানারকম জটিলতা আছে।

এই সেই জোড়াতালির পরে কারও নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে, কারওবা হয়নি। এছাড়া খসড়া আইনে নানা ধরনের অসংগতি আছে। বিক্রয়ের পাশাপাশি কেনাকাটাতেও দেওয়া হয়েছে বাধ্যবাধকতা। ক্রেতার টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রেও আছে হস্তক্ষেপ। আবার ক্রয়কৃত পণ্য হতে হবে নির্দিষ্ট সংখ্যক। এইসব নানা অসংগতি এড়িয়ে যেকোনো ক্ষুদ্র উদ্যোগের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন >>> নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন

যেহেতু দেশে এখন ই-কমার্সের একটা বিশাল বাজার সৃষ্টি হয়েছে এবং বাজার ক্রমবর্ধমান সুতরাং এই খাত থেকে সরকারের বড় রকমের রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২৯ এপ্রিল ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে কর আদায় সংক্রান্ত এক সংলাপ অনুষ্ঠানে কর আদায় বাড়ানোর জন্য সরকারকে রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার করতে পরামর্শ দিয়েছে। আমাদের ই-কমার্স মার্কেট সাইজটা অভিভূত হওয়ার মতোই।

২০২২ সালের শেষে ই-কমার্স মার্কেট সাইজ ছিল ৬৬০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগামী চারবছর পর ২০২৬ সালে বাজার আকৃতি বেড়ে হয়ে যেতে পারে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার।

টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই সংখ্যাটা ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে। সুতরাং ভীষণরকম যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত একটা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এখানে দরকার তাতে করে সরকারই লাভবান হবে।

আমরা নাগরিক হিসেবে দেশের উত্তরোত্তর সাফল্যের জন্য জিডিপির প্রবৃদ্ধি চাই, আবার একইসাথে চাই প্রবৃদ্ধির এই চাপ যেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের গলার কাঁটা না হয়। এমন যেন না হয় সরকারের অতিরিক্ত আয়ের প্রত্যাশা ও ডিজিটাল আইনের বেড়াজালে আটকে উদ্যোক্তাদের ব্যবসাই আর করা হয়ে উঠল না!

ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার-ই ট্রেড