ছবি : সংগৃহীত

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড বেতনের জন্য আন্দোলন করছেন। দশম গ্রেডে উন্নীত হলে সর্বসাকুল্যে একজন শিক্ষকের বেতন হবে ২৭ হাজার টাকা প্লাস কিছু। বর্তমান বাজারে এই টাকায়ও কি পরিবার নিয়ে চলা সম্ভব?

সরকারের অন্যান্য পদে যারা আছে তাদের নানা সুবিধা ও নানা উপরি আয়ের সুযোগ আছে। শিক্ষকদের সেটা নেই। শিক্ষকদের সৎভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের, সরকার কি সেই কাজ করছে?

কলকাতার প্রাইমারি শিক্ষকরা ৩০ হাজার টাকার বেশি বেতন পায় অথচ সেখানে বাসা ভাড়া ও জিনিসপত্রের দাম আমাদের চেয়ে অনেক কম। তার মানে কার্যকরী বেতন ৩০ হাজারের চেয়ে বেশি। অথচ আমাদের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা মাসিক ২৭ হাজার টাকা বেতন দাবি করে এখন রাস্তায়।

আরও পড়ুন >>> নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়? 

এই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসঙ্গে তার বেতন কত জানতে চেয়েছিলাম। এমনিতেই কাউকে তার বেতন কত জিজ্ঞেস করা ঠিক না। যাই হোক আপনারা কি জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকের কী যোগ্যতা লাগে আর তার বেতন কত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও) শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে একজন শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম বিএস (অনার্স) এবং মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৫ পেতে হয়। তবে ন্যূনতম যোগ্যতা যথেষ্ট নয়। সাধারণত ক্লাসের সেরা ছাত্ররাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে শিক্ষক হন।

সেই শিক্ষক মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ৩৫ হাজার টাকা। তার যদি স্ত্রী থাকে, যদি একটা বাসা ভাড়া করে থাকতে হয় তাহলে বর্তমান বাজারমূল্যে এই ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে কীভাবে চলা যায় তার একটা হিসাব কি কেউ আমাকে দিতে পারবেন?

গোটা বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষকদের এত কম বেতন। তাহলে কেন আমাদের দেশের মেধাবীরা পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আসবে?

একটু আগে প্রভাষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা যেটা দিয়েছিলাম সেটা ন্যূনতম। আমেরিকায় পিএইচডি করে ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (যা পোস্ট-ডকের সমতুল্য) ৩-৫ বছর চাকরি করেও প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার উদাহরণ আছে। শুধু পিএইচডি করে প্রভাষক হওয়ার উদাহরণও অসংখ্য।

সাধারণত সারা পৃথিবীতে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ হয় সহকারী অধ্যাপক পদে কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় প্রভাষক হিসেবে যদি তার ৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকে। তার অর্থ একজন শিক্ষার্থী মাস্টার্স করার পর ৪ থেকে ৬/৭ বছর গবেষণা ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে পিএইচডি করার পর প্রভাষক হচ্ছেন আর বেতন পাচ্ছেন মাত্র ৩৫ হাজার টাকা।

আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা! 

গোটা বিশ্বে বাংলাদেশেই শিক্ষকদের এত কম বেতন। তাহলে কেন আমাদের দেশের মেধাবীরা পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে আসবে? ন্যূনতম বেতন স্কেল যাই-ই থাকুক পিএইচডি ডিগ্রির জন্য বড় একটা ইনক্রিমেন্ট তো সরকার দিতে পারে। প্রতি ১ বছরের পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতার জন্য একটা বড় ইনক্রিমেন্ট দিতে পারে।

প্রতিটি গবেষণা পত্র প্রকাশের জন্য একটা ছোটখাটো ইনক্রিমেন্ট কিংবা এককালীন কিছু টাকা দিতে পারে যেমন বুয়েটের বর্তমান ভিসি সত্য প্রসাদ মজুমদার এটি ইতিমধ্যেই চালু করেছেন। এইভাবে শিক্ষকদের তাদের অতিরিক্ত যোগ্যতার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তাদের পেশার মান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। কারণ বর্তমানে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে বেতন পান তা দিয়ে কোনোভাবেই চলা সম্ভব না।

চলতে কষ্ট হয় দেখেই শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় পার্ট-টাইম কিছু একটা করে বাড়তি আয় করছেন। যারা পার্ট-টাইম কোথাও পড়াচ্ছেন না তারা অন্য কোনো পথে হাঁটছেন। যেমন—রাজনীতি, কনসালটেন্সি ইত্যাদি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কারা? শিক্ষার্থীরা। কারণ শিক্ষার্থীরা তার শিক্ষকের মেধা ও কাজের সম্পূর্ণটা পাচ্ছে না।

তাছাড়া কম বেতনের জন্য শিক্ষকরা নানাভাবে নানা উছিলায় কিছু অতিরিক্ত টাকা আয়ের কিছু আপাত বৈধ উপায় বের করছে যেমন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেই পার্ট-টাইম শিক্ষক, নিজের কোর্সের উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য টাকা পাওয়া, একাডেমিক নানা কমিটির মিটিং-এ উপস্থিতির জন্য এনভেলপ মানি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?

শিক্ষক পদটা এমন একটি পদ যেই পদে থেকে একজনকে উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে হয়, যেন শিক্ষার্থীরা তার জীবন থেকেও শেখে। কিন্তু আমরা এমন উদাহরণ তৈরি করতে পারছি না। দিন যত যাচ্ছে শিক্ষার সংকট তত বাড়ছে। যতদিন শিক্ষকদের এইসব সমস্যার সমাধান হবে না রাষ্ট্রে ভালো মানের মানুষ তৈরির আশা কেবলই দুরাশা হয়ে থাকবে।

এ তো গেল শিক্ষকদের বেতনের কথা। এবার আসি প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে। রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩৪২টি। এগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব জমি, যেখানে রাজধানীর অনেক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভাড়া বাসায় কার্যক্রম চালায় (প্রথম আলো, ০৫ মে ২০২৩)।

তিন মাসে ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দুরবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। তিনি জানিয়েছেন এসব বিদ্যালয়গুলো সবদিক দিয়ে দেখতে যেমন গরিব, সেখানে পড়েও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। রাষ্ট্র এই শিশুদের অনাথ হিসেবে দেখে।

আগে ভারতের রাজধানী দিল্লির সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের অবস্থা ঢাকার সরকারি স্কুলগুলোর মতোই ছিল। সেই অবস্থা এখন আর নেই। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সব বদলে দিয়ে একদম প্যারাডাইম শিফট করে ফেলেছেন।

কেজরিওয়াল ছিলেন একজন সরকারি আমলা। অসাধারণ মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক এই আমলা ২০১৫ সাল থেকে বদলে দিয়েছেন গোটা দিল্লির শিক্ষাব্যবস্থা। ২০১৫ সালের আগে আমাদের দেশের মতোই সরকারি স্কুলে কেউ তার সন্তানদের পাঠাতো না। সেখানে আমাদের মতোই রমরমা ছিল প্রাইভেট স্কুল আর কোচিং ব্যবসা।

কেজরিওয়াল যখন থেকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় আসেন তখন থেকে বদলে যেতে থাকে দিল্লির সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের অবস্থা। ভাঙাচোরা স্কুল মেরামত হতে থাকে, মেরামতের অযোগ্য ভবন ভেঙে সম্পূর্ণ নতুন স্থাপত্য ডিজাইনে নতুন করে ভবন বানানো হয়।

আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

স্কুলবাস দেওয়া হয় স্কুলে, শ্রেণিকক্ষে এসি বসানো হয়, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়, নতুন ও উন্নত মানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় আর পুরোনোদের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ফলাফল কী?

কেজরিওয়াল যখন থেকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় আসেন তখন থেকে বদলে যেতে থাকে দিল্লির সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুলের অবস্থা....

দিল্লির কোচিং বাণিজ্য এবং প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসা লাটে ওঠে। কয়েক বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার ছাত্রছাত্রী বেসরকারি স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে আসে। অভিভাবকদের অতিরিক্ত শিক্ষা ব্যয় কমে যায়।

স্কুলগুলোয় সমাজের উঁচু-নিচু সব স্তরের ছাত্রছাত্রী দ্বারা মুখরিত হতে থাকে যা হওয়া উচিত। কেজরিওয়াল বলেছিলেন, তিনি এমন করে স্কুলগুলো তৈরি করতে চান যাতে মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের ছেলেমেয়েরাও সরকারি স্কুলে পড়তে উৎসাহিত হয়।

আগে বস্তির ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসতে চাইতো না। এখন স্কুলের পরিবেশ এত সুন্দর যে নিজ আগ্রহে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। এর ফলে কী হচ্ছে? ধনী-গরিবের মিশ্রণ ঘটছে, বৈষম্য কমছে, বন্ধুত্ব বাড়ছে। একে অপরকে জানার-বোঝার সুযোগ পাচ্ছে।

প্রত্যেক এলাকায় বাচ্চারা তার নিজ এলাকার সরকারি স্কুলে পড়ছে। এতে ট্রাফিক জ্যাম কমছে। বাচ্চাদের যেহেতু বিকেলে কোচিং-এ যেতে হয় না তাই তারা বিকেলে খেলাধুলা করার সুযোগ পাচ্ছে। অভিভাবকদের কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর জন্য অতিরিক্ত খরচ বেঁচে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> মাধ্যমিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠ : চ্যালেঞ্জ ও করণীয় 

শিক্ষকরা যেহেতু ভালো বেতন পাচ্ছেন, ভালো সম্মান পাচ্ছেন তারাও আয়ের জন্য অন্য পথে যাচ্ছেন না। সৎ শিক্ষকদের কাছে পড়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সৎ মানুষের উদাহরণ পাচ্ছেন। এতে করে বহুমাত্রিকভাবে লাভবান হচ্ছেন সবাই।

আমাদের সরকার, শিক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কবে এসব বুঝবে? এরা কি জানে না আমাদের সমাজের সব মানুষ ভালো না থাকলে তারা এবং তাদের সন্তানরাও ভালো থাকবে না?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়