সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘আমরা তো ভারতে থাকতে যাই না, তাদেরকে দিতে যাই; আমরা গিয়ে কেনাকাটা না করলে কলকাতার মানুষের রুটি-রুজির কী হবে?’ যিনি লিখেছেন, তিনি নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কর্মরত। কাজ করেছেন বড় বড় গণমাধ্যমেও। তার এই লেখায় গ্লাসের গল্প মনে পড়ল। গ্লাসে অর্ধেক পানি, নাকি অর্ধেক খালি। এতো বড় ভারত প্রেমিক তিনি যে, প্রবাসীদের কষ্টে অর্জিত ডলার খরচ করেন কলকাতায় গিয়ে। কিন্তু আসল ঘটনা কী? মূলত ভারতের পোশাক না পরলে তার সৌন্দর্য বাড়ে না; সেখানে চিকিৎসা না করালে স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। আবার পরিবার নিয়ে ভারতে বেড়াতে না গেলে মন ভালো থাকে না। সবটাই করছেন ব্যক্তিগত লাভের জন্য, অথচ তিরস্কার করছেন অন্য দেশের মানুষকে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের আমন্ত্রণে আসছেন। তাতেই এক গোষ্ঠী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। প্রতিহতের ডাকও এসেছে। বলছেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাত গুজরাট দাঙ্গায় রঞ্জিত।’ যদিও বাংলাদেশ সরকার তাদের বাধাও দিচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রগতিশীল’ নামের সংগঠন আন্দোলন করছে। আবার হেফাজতও মাঠ গরম করছে।

আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময় ভয়ংকর অবস্থায় পৃথিবী। মহামারি করোনাভাইরাস তছনছ করে দিচ্ছে সবকিছু। তবু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই অন্যতম প্রতিরোধ। টিকা আসায় যেমন স্বস্তি আছে, তেমনি করোনাভাইরাস আরও শক্তিশালী হওয়ায় চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে। এই পরিস্থিতি সীমিতভাবে হচ্ছে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠান। সেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কম। তবে টেলিভিশনের পর্দায় উপভোগ করতে পারছেন দেশের মানুষ। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারত সরকারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাই বাংলাদেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান অপরিসীম। জাতির পিতাকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির জন্য ভারত সরকারের অবদান ভুলবার নয়। এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য-যোগাযোগসহ সবক্ষেত্রে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের কাছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে জল ঘোলা করার চেষ্টা করছে একটি মহল। কিন্তু কেন তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরোধিতা করছেন? তারা বলছেন, ‘ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রদায়িক।’  তাই যদি বিরোধিতার কারণ হয়, তাহলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং’র সফরের বিরোধিতা করা হলো না কেন? চীনের উইঘুরে মুসলিম হত্যা, গণধর্ষণের প্রতিবাদে রাজপথ গরম হলো না কেন?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান অপরিসীম। জাতির পিতাকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির জন্য ভারত সরকারের অবদান ভুলবার নয়। এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য-যোগাযোগসহ সবক্ষেত্রে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের কাছে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা হত্যার প্রতিবাদে বড় আন্দোলনও হয়নি বাংলাদেশে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন ঢাকায় আসেন, তখনও প্রতিবাদ হয়নি। ইরাক যুদ্ধের সময় বোমা মেরে ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করল আমেরিকা; প্রাণ হারালেন নিরীহ মানুষ। এসবের প্রতিবাদে রাজপথ গরম হয়নি। এর বিপরীতে ‘ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে গরুর মাংস বিক্রেতাকে হত্যা’ সব ঘটনার রেশ পড়েছে বাংলাদেশে। প্রতিবাদ হয়েছে। ওই দেশের কিছু মানুষের অন্যায় কাজের জন্য, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষকে নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।

ঘটনার পূর্বাপর বলছে, ভারতে কিছু হলে ‘তাদের’ যতটা অনুভূতি জাগে, অন্য দেশের বেলায় ততটা জাগে না। অথবা ‘তাদের’ অনুভূতি তখনই জাগ্রত হয়, যখন স্বার্থে টান পড়ে। মানবতার কারণে সত্যিই যদি ‘তাদের’ অনুভূতি জাগে, তাহলে চীন-মিয়ানমার-আমেরিকার বেলায় কোথায় থাকে ‘তাদের’ অনুভূতি! তবে এটাও ঠিক, স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে দেশের মানুষ বিচলিত নয়। হাজার বছরের সম্প্রীতি এখনো ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িক হামলা করলেও কোটি কোটি মানুষ এখনো এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ধর্ম-বর্ণ মুছে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। জাতিসংঘ এখন বিভিন্ন সদস্য দেশকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সরল স্বীকারোক্তি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের এই উন্নয়ন যাত্রা অব্যাহত রাখতে প্রতিবেশী ভারতকেও পাশে রাখতে হবে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগের উন্নতির জন্য ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দুটি দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংযোগ চুক্তি কার্যকর হচ্ছে। আঞ্চলিক যোগাযোগ কেবল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বকেই জোরদার করছে না, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রও শক্তিশালী হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। জাতিসংঘ এখন বিভিন্ন সদস্য দেশকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে।

২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেখানে বাংলাদেশ এবং ভারত একে অপরের সীমান্তের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের যানবাহন ভারতের ভূখণ্ডের মাধ্যমে ভুটান এবং নেপালে পণ্য পাঠাতে পারবে। ভারত উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বাংলাদেশের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এটি আঞ্চলিক সংযোগের নতুন যুগের সূচনা করবে।

বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, নেপাল এবং ভুটান বহুপক্ষীয় সহযোগিতার সুযোগ পাবে।

করোনার মহামারির মধ্যে নরেন্দ্র মোদি এই প্রথম বিদেশ সফর করছেন। তাও আবার বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, করোনা টিকা নিয়ে বিশ্বে যখন হাহাকার, তখন বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন পাঠিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এ নিয়েও ষড়যন্ত্র কম হয়নি। একবার বলা হলো, করোনার ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে দেবে না ভারত। যখন বাংলাদেশে ভ্যাকসিন এলো, তখন বলা হলো- ভেজাল ভ্যাকসিন পাঠানো হয়েছে। এই ভ্যাকসিন নিয়ে যারা তাচ্ছিল্য করেছিলেন তারাই আবার ওই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেন মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেন, তার উত্তর কিন্তু তারা দেননি।

সব চক্রান্ত পায়ে ঠেলে, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বন্ধন এগিয়ে চলছে। এই সম্পর্কগুলো এতটাই অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা।

বিপ্লব কুমার পাল ।। গণমাধ্যমকর্মী