ছবি : সংগৃহীত

ঈদ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে যে ছবি ভেসে ওঠে তা হলো, ছুটি, উৎসব, প্রিয়জনের সাথে দেখা, পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া ইত্যাদি, কারণ জীবন ও জীবিকার কারণে আমাদের যে ছুটে চলা সেখানে কয়জন আর প্রতিদিন ঘরে ফিরে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের কাছে পায়, এমন সৌভাগ্য হাতেগোনা অল্প কিছু মানুষের।

কেউ যেমন পরিবার ফেলে রাজধানীতে আসে আবার কেউ রাজধানী ছেড়ে যায় দেশের অন্য কোনো প্রান্তে। এরা প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে ঈদের জন্য, আর এই মানুষগুলো নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সবগুলো মাধ্যম কাজে লাগিয়ে সুন্দর ঈদ উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যে পরিমাণ চাহিদা থাকে যাতায়াতের সেই তুলনায় আমাদের মানসম্মত যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে ঈদযাত্রার সাথে যে শব্দটি যুগপৎভাবে আসে সেটা হলো দুর্ভোগ।

২০২৩ সালের ঈদুল ফিতর ছাড়া আজ পর্যন্ত যত ঈদ উদযাপিত হয়েছে তার সবগুলো ঈদযাত্রায় সরকারের অনেক প্রচেষ্টা থাকলেও দুর্ভোগ ছিল প্রকট। সড়ক পথে যাতায়াতে প্রথম যে দুর্ভোগ চোখে পড়ে তা হলো বাড়তি ভাড়া আদায়। এরপর বেশি ভাড়া দিয়ে টিকিট কিনে আপনি যখন বাড়িতে যাওয়ার জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে বাস টার্মিনালে আসবেন তখন দেখা যাবে নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে না। টার্মিনালগুলোর পরিবেশ এত ভালো না যে, কেউ পরিবার নিয়ে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে। এরপর গাড়ি ছেড়ে গেলে বড় যে সমস্যা চলে আসে তা হলো যানজট।

আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন 

ঈদযাত্রায় যানজটের ভোগান্তিতে পড়েননি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। সড়ক পথের ভোগান্তি এড়াতে যারা রেলপথ বেছে নেন তারা এতদিন পর্যন্ত যে ভোগান্তিতে পড়েছে তা হলো স্টেশনে এসে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করা। সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে সকালে টিকিট না পেয়ে ফিরে যাওয়া ছিল নিত্য অভিজ্ঞতা।

রেলে আস্তে আস্তে আধুনিকায়নের ধারাবাহিকতায় এখন শতভাগ টিকিট অনলাইনে সংগ্রহ করতে হয় আর এর ফলে এতদিনের সারারাত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট সংগ্রহের দুর্ভোগ থেকে যাত্রীরা মুক্তি পেল।

দ্বিতীয় যে দুর্ভোগ ছিল রেল যাত্রায় তা হলো, টিকিট সংগ্রহ করেও নিজের সিটে বসতে না পারা এমনকি টিকিটবিহিন যাত্রীদের চাপে ট্রেনে উঠতে না পারার মতো অভিজ্ঞতাও ছিল অনেক। এছাড়া ঈদের সময় ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ছিল একটি সাধারণ ঘটনা যা যাত্রীদের দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিত।

ঈদযাত্রায় যারা নৌপথে ভ্রমণ করে তাদের দুর্ভোগ শুরু হয়ে যায় গুলিস্তান থেকেই কারণ অতিরিক্ত লঞ্চ যাত্রীদের চাপে সদরঘাটমুখী রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট দেখা দেয় এবং পরিবার-পরিজন ও মালামাল নিয়ে মানুষের হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এর সাথে যুক্ত হয় লঞ্চের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও দেরি করে ছাড়া।

২০২৩ সালের ঈদুল ফিতর ছাড়া আজ পর্যন্ত যত ঈদ উদযাপিত হয়েছে তার সবগুলো ঈদযাত্রায় সরকারের অনেক প্রচেষ্টা থাকলেও দুর্ভোগ ছিল প্রকট। সড়ক পথে যাতায়াতে প্রথম যে দুর্ভোগ চোখে পড়ে তা হলো বাড়তি ভাড়া আদায়।

এই তিন মাধ্যমের চাইতে ব্যতিক্রম হচ্ছে আকাশ পথ কারণ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির যাত্রী এই পথে ভ্রমণ করেন। তবে ঈদের সময় আকাশ পথেও বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। সব ভোগান্তি শেষে যাত্রা শুরু করলেও যে ঝুঁকি সব যোগাযোগ মাধ্যমেই বিদ্যমান তা হলো, সড়ক দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ পুলিশ ও গণমাধ্যমের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায় যে, সারা বছর প্রতিদিন গড়ে যত দুর্ঘটনা ঘটে তারচেয়ে ঈদের দিন ও আগে-পরে তিন দিনসহ মোট সাত দিনে, সড়ক দুর্ঘটনার হার প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ যারা ঈদযাত্রা করছেন তারা সকলেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন বা কর্মক্ষেত্রে ফেরত আসবেন।

আরও পড়ুন >>> রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?

ঈদযাত্রার এমন দুর্ভোগ আর ঝুঁকি কমাতে সরকারের প্রস্তুতিও থাকে অনেক। এতদিন পর্যন্ত সব প্রস্তুতির পরও শেষ পর্যন্ত ঈদের আগের দুর্ভোগ ছিল সাধারণ ঘটনা। কিন্তু ২০২৩ এর ঈদুল ফিতর ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এইবার প্রথম প্রায় সব যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সকল রুটে যাত্রীরা বাড়ি যেতে ও ফেরত আসতে পেরেছেন কোনো প্রকার যানজট ছাড়া।

এমনকি এবার ঈদের সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার হারও ছিল অনেক কম। তাই সরকার, তার সব সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার। এছাড়া বছরের শুরুতে পদ্মা সেতু ও শত সেতু-সড়ক উদ্ভোধন ঈদযাত্রা করেছে স্বস্তির।

দীর্ঘদিনের ঈদযাত্রার ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে সংস্থাগুলো এখন অনেক পরিণত এবং যানজটের কারণ, স্থান ও সময় চিহ্নিত করে দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ ও প্রস্তুতি পূর্বের ঈদের যাত্রা করেছে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের। আর ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে যাত্রার সফলতা মানুষের আশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং এই পরিস্থিতি ধরে রাখা সংস্থাগুলোর জন্য এবারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ঈদুল ফিতরের আগে মানুষ শহর ছেড়ে যায় এবং তখন ফেরত আসার দিকে চাপ কম থাকে। বিপরীতে ঈদুল আজহার সময় একদিকে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যায় অন্যদিকে পশু বোঝাই ট্রাক শহরে প্রবেশ করে। তাই এই সময় দুর্ঘটনা ও যানজটের ঝুঁকি পূর্বের চেয়ে বেশি থাকে বিশেষ করে যেসব সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার নেই, সেখানে ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই এই সময় পূর্বের ঈদের ন্যায় এবারও মনিটরিং ও পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হয়েছে।

মহাসড়কে গতিসীমা মেনে চলার ব্যাপারে প্রচার ও মনিটরিং পরিচালনা করতে হবে। ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের মহাসড়ক ও তার পরিবেশ এখনো দূরের যাত্রায় মোটরসাইকেল উপযোগী নয়।

এছাড়া মহাসড়কের পাশে পশুর হাটগুলো হতে পারে যানজটের সূত্র। তাই চেষ্টা করতে হবে যেন, ইজারাকৃত স্থানের বাইরে যেন পশুর হাট না আসে এবং প্রয়োজনে মহাসড়কের প্রয়োজনীয় স্থানে রাস্তা বরাবর পাশে অস্থায়ী ব্যারিকেড দেওয়া যেতে পারে যেন আচমকা কোনো পশু বা মানুষ রাস্তায় চলে না আসে।

মহাসড়কে গতিসীমা মেনে চলার ব্যাপারে প্রচার ও মনিটরিং পরিচালনা করতে হবে। ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের মহাসড়ক ও তার পরিবেশ এখনো দূরের যাত্রায় মোটরসাইকেল উপযোগী নয়। তাই হেলমেটবিহীন, কম সিসি ও একাধিক যাত্রী বহন নিরুৎসাহিত করতে হবে।

আরও পড়ুন >>> পদ্মা সেতু : পর্যটন সম্ভাবনার নতুন করিডর

এবারের ঈদের সময়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায়, নৌপথে বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে বিশেষ করে অতিরিক্ত যাত্রী ও পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট বা বয়া নৌযানে রাখতে হবে। রেল কর্তৃপক্ষ টিকিট সংগ্রহের দুর্ভোগ থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে পারলেও ট্রেনের ছাদে ওঠা ও বিনা টিকেটে যাত্রীদের ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে এখনো পুরোপুরি সফল নয়। এক্ষেত্রে ঈদের কিছুদিন যাত্রার প্রথম ও শেষ স্টেশনে নিরাপত্তারক্ষী বাড়িয়ে এবং প্রবেশপথ ও বহির্গমনের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এছাড়া কোনো ট্রেন বা মোটরযান বা নৌযান দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত যোগাযোগ পুনঃস্থাপন ও চিকিৎসা প্রদানে জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে। এটা অনস্বীকার্য যে, ঈদের সময়ের যাতায়াতের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার তুলনায় জোগান অপ্রতুল তাই, পুরোপুরি স্বস্তির যাত্রা প্রদান করা সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ কিন্তু পূর্বের স্বস্তি এটা প্রমাণ করে যে, চাইলে সুন্দর একটি ঈদযাত্রা উপহার দিতে বাংলাদেশ এখন প্রস্তুত।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস