করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ রোধে সারাদেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলছে। তবে সরকার যতটা গর্জেছে, বর্ষণ ততটা হয়নি। 

৭ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সব সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেভাবে আগাচ্ছে তাতে যেকোনো সময় শপিং মল খোলার বিষয়েও সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

সবকিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবেই। অফিস-আদালত, ব্যাংক-পুঁজিবাজার তো বটেই এমনকি সল্প সময়ের জন্য খোলা আছে বইমেলাও। করোনার সংক্রমণ যেভাবে প্রতিদিন রেকর্ড গড়ছে, তাতে কঠোর কোনো একটা ব্যবস্থা ছাড়া উপায় ছিল না, এটা বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন অনেকদিন ধরেই।

সরকার প্রথমে ১৮ দফা নির্দেশনাও দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা পালনে কারো কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে সরকার এক সপ্তাহের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত যতটা কঠোর, বাস্তবায়ন ততটাই ঢিলেঢালা। তাই এই নামকাওয়াস্তে কঠোর নিষেধাজ্ঞায় সংক্রমণ ছড়ানো রোধে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। এর আগে সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময়ও দেশ ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি কাটিয়েছে। সেই ছুটির ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও কঠোর নিষেধাজ্ঞায় দেশ। কঠোর নিষেধাজ্ঞা বাড়বে কি কমবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।

সরকার প্রথমে ১৮ দফা নির্দেশনাও দিয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা পালনে কারো কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে সরকার এক সপ্তাহের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত যতটা কঠোর, বাস্তবায়ন ততটাই ঢিলেঢালা।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানুষের জীবন বাঁচাতেই সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু জীবনের সাথে জীবিকারও প্রবল যোগাযোগ রয়েছে। করোনার বিস্তার যত প্রবলই হোক, মানুষের পেট তো তা বুঝবে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাকে খেতে হবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবন কেটে যায় জীবিকার সন্ধানে। করোনাভাইরাস মানুষের জীবনের ওপর যতটা আঘাত হেনেছে, ততটাই হেনেছে জীবিকার ওপরে।

করোনার প্রথম ধাক্কা অনেক মানুষের জীবন যেমন কেড়ে নিয়েছে, ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের জীবিকাও। অল্পকিছু টাউট-বাটপার ছাড়া করোনা বেশিরভাগ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষ করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা খুব একটা টের পাননি। কারো হয়তো আয় কমেছে বা সঞ্চয়ে টান পড়েছে; কিন্তু সেটা তারা সামলে নিতে পেরেছেন।

মধ্যবিত্তের সঙ্কট নানামুখী হলেও জীবনযাত্রার মান কমিয়ে, ব্যয় সমন্বয় করে তারা কোনোরকমে টিকে আছেন। সমস্যা হলো দৈনিক আয়ের মানুষের। করোনার প্রথম ধাক্কা নিম্ন মধ্যবিত্তের অনেককে বেকার করেছে আর নিম্নবিত্তের মানুষকে ফেলেছে জীবিকার সঙ্কটে। প্রথম ধাক্কার সময় আমরা দেখেছি, অনেক মানুষের শিকড় উপড়ে গেছে। অনেকে ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেছেন গ্রামে।

এবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার সময় প্রথমবারের অভিজ্ঞতা সরকারের মাথায় ছিল। তাই শুরু থেকেই অর্থনীতি সচল রেখেই কঠোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পরিকল্পনা সরকারের। কিন্তু সরকারের নানান সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে, তাদের মাথায় অর্থনীতি থাকলেও মানুষ নেই। আর মানুষ থাকলেও তারা উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা বড় জোর মধ্যবিত্ত। নিম্নবিত্তের মানুষের ভাবনাটাই সরকারের মাথায় খুব একটা নেই।

অফিস-আদালত, ব্যাংক-পুঁজিবাজার খোলা। কিন্তু ঘর থেকে না বের হলে যাদের চুলা জ্বলে না, তাদের খবর কে নেবে? করোনা গরিবকে আরও গরিব করেছে, তাদের কাজ চলে গেছে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের ব্যবসা শূন্য। গৃহ পরিচারিকাদের আসতে নিষেধ করেছেন। দিনমজুররা বাধ্য হয়ে রাস্তায় বেরোয়, কিন্তু তাদের কাজ নেই।

করোনার বিস্তার যত প্রবলই হোক, মানুষের পেট তো তা বুঝবে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাকে খেতে হবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবন কেটে যায় জীবিকার সন্ধানে। করোনাভাইরাস মানুষের জীবনের ওপর যতটা আঘাত হেনেছে, ততটাই হেনেছে জীবিকার ওপরে।

রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ ছিল দেখে বাধ্য হয়ে বাইকাররা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীরা রাস্তা অচল করে দিয়েছেন। গত ঈদে তাদের ব্যবসা ছিল না। এবারও না হলে অনেক ব্যবসায়ীকে পথে বসতে হবে। প্রচলিত-অপ্রচলিত অনেক পেশার মানুষ কাজ হারিয়েছেন। যেমন করোনা বেড়ে গেলে মানুষ সেলুনে যেতে ভয় পান, বিউটি পার্লারও খা খা করে। ভিক্ষা করে চলারও উপায় নেই। রাস্তায় তো ভিক্ষা দেওয়ার মানুষও নেই।

গতবছর সাধারণ ছুটির সময় সরকার তবু নানাভাবে প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। যদিও সেই চেষ্টা নিয়েও নানান নয়-ছয় হয়েছে। তবু অনেকে সরকারের সহায়তা পেয়েছেন। তাছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন  সামাজিক সংগঠন, এনজিও নানাভাবে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছিল নানান সামাজিক উদ্যোগও। কিন্তু এবার তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না; সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু একটি কল্যাণ রাষ্ট্র, মানবিক সমাজের প্রথম কাজ হলো গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই দুঃসময় নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে। কিন্তু ততদিন যেন প্রান্তিক মানুষগুলো টিকে থাকতে পারেন।

জীবন অবশ্যই মূল্যবান, কিন্তু সেই জীবন বাঁচাতে জীবিকার মূল্যও কম নয়। গরিব মানুষ করোনায় বাঁচলেও ক্ষুধায় যেন মরার মতো না বাঁচে। সবাইকে বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। করোনার মৃত্যুর তবু রেকর্ড আছে। জীবিকার সঙ্কটে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষদের যেন আমরা ভুলে না যাই।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com