ভারতীয় ক্রিকেটের দুই দিকপাল বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মার মধ্যকার টানাপোড়ন মিটিয়েছেন সে দেশের কোচ রবি শাস্ত্রী, এমন একটা খবর এসেছে সম্প্রতি। কোহলি ও রোহিতের সম্পর্কের এতোটায় অবনতি হয়েছিল যে, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিনায়ক কোহলিকে ‘আন ফলো’ করেছিলেন রোহিত। এসব নিয়ে গুঞ্জন থাকলেও খবরটা সেভাবে চাউর হয়নি। মিডিয়ার সামনে মুখ না খুলে খুব সাবধানে পরিস্থিতি সামলেছে ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজম্যান্ট।

মিডিয়াকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বিষয়টি নিয়ে গোপনে তদন্ত করে ভারত বোর্ড। এরপর দু’জনের দ্বন্দ্ব নিরসনে দায়িত্ব তুলে দেয় কোচ রবি শাস্ত্রীর কাঁধে। দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে সমস্যার সমাধান করেছেন শাস্ত্রী। রোহিত ও কোহলি আবার আগের মতোই কথা বলছেন পরস্পরের সঙ্গে। আর এতে স্বস্তির শ্বাস ভারত বোর্ড তথা ভারতীয় ক্রিকেটে।

মনে করেন ঘটনাটি বাংলাদেশে। দলের শীর্ষ ক্রিকেটার কিংবা ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট দু’জনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত দেখা দিল। কি ঘটবে তা সহজেই অনুমেয়। সবার আগে দু’জন পাল্লা দিয়ে মিডিয়াতে দোষারোপ করবেন একে অপরকে। বিষয়টি চরম আকার ধারণ করার পর বোর্ড হস্তক্ষেপ করবে। ক্রিকেটারদের দোষারোপ করবে। দিনের পর দিন চলবে ‘ব্লেম গেম’। মাঠের খেলার চেয়ে গ্রেট ক্রিকেটারদের ‘কথার যুদ্ধ’ বড় খবর হবে মিডিয়াতে।

সম্প্রতি নিউজিল্যান্ড সফরে না গিয়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের আইপিএল খেলতে যাওয়াকে কেন্দ্র করে যা ঘটল সেটাকে কী বলা যায়? সাবেক ক্রিকেটার আকরাম খান তথা বিসিবিকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন সাকিব। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বদলে বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে বিসিবি। 

বিসিবির সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের যেন কোনো শেষ নেই। দলের ক্রিকেটারদের নাম ধরে বিসিবি প্রধানের সমালোচনা করাটা তো বাংলাদেশ ক্রিকেটে নৈমিত্তিক ঘটনা।

বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের কি অবস্থা এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সিরিজ চলাকালীন কোচের বিপক্ষে বিষোদগার করেন ক্রিকেটাররা। প্লেয়ারদের নাম ধরে ধরে, সমালোচনাকে উস্কে দেন ক্রিকেট কর্ণধাররা। ঘরের খবর পরকে জানানোর জন্য যেন মুখিয়ে আছেন সবাই। সাবেক ক্রিকেটারদের নিয়ে সমালোচনা করেন এ সময়ের ক্রিকেটাররা। পাল্টা কথার তোপ দাগান সাবেকরা। কথার যুদ্ধে জিততে পারার মধ্যেই যেন সকল সার্থকতা! মাঠের খেলা গোল্লায় গেলে কী আসে যায়?

সম্প্রতি মাঠের খেলায় কোনো সুসংবাদ নেই। টেস্ট ক্রিকেটের পুচকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারের ক্ষত এখনো দগদগে। সর্বশেষ ঘরের মাঠে তৃতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারতে হয়েছে। নিউজিল্যান্ড সফরেও হারের বৃত্তেই বন্দি ক্রিকেট দল।

শুধু ক্রিকেটে কেন সব খেলাতেই একই অবস্থা। নেপালে ত্রিদেশীয় ফুটবল ফাইনালে স্বাগতিকদের কাছে হেরেছে জামাল ভুঁইয়ারা। মনে রাখতে হবে ফুটবলে নেপাল তেমন কোনো প্রতিষ্ঠিত নাম নয়। ফাইনালে হারের চেয়েও বাংলাদেশের খেলার ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফাইনালে হার ১-২ গোলে। কিন্তু খেলার ধারা অনুযায়ী ব্যবধান ৪/৫ গোলে হতেই পারত। 

চ্যাম্পিয়ন হলে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে, বাফুফের এই ঘোষণাও উদ্দীপ্ত করতে পারেনি ফুটবলারদের। কিছুদিন আগে বাফুফে নির্বাচন নিয়ে উত্তাপ আর উত্তেজনা উঠেছিল তুঙ্গে। কথা আর পাল্টা কথার কত মারপ্যাঁচ! অথচ মাঠে ফুটবলারদের পারফরম্যান্স একেবারে সাদামাটা।

ধরা যাক হকির কথাই। একটা সময়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের হৃদয় জুড়ে ছিল হকি। সেই হকি এখন তলানিতে। বছর জুড়েই হকিতে মাঠের চেয়েও মাঠের বাইরের সংবাদই বেশি আসে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞা, বয়কট বছরের পর বছর ধরে এভাবেই কাটছে হকির দিন।

আবারও আসা যাক কোহলি-রোহিত দ্বন্দ্ব মোচনে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের উদ্যোগের জায়গাটিতে। কোহলি-রোহিতের দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে মিডিয়া থেকে আড়ালে রাখতে সমর্থ হয়েছে সে দেশের বোর্ড। গোপনে তদন্ত করেছে, কেউ টেরও পায়নি। সমস্যা সমাধানে দায়িত্ব দেওয়া হয় শাস্ত্রীকে। সবকিছুই থেকে গেছে মিডিয়ার অগোচরেই। অর্পিত দায়িত্ব শতভাগ পালন করেছেন শাস্ত্রী। এরপর খবর এসেছে মিডিয়াতে।

মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দল উঠেছিল সাফল্যের চূড়ায়। এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে ধোনি বলেছিলেন, তাদের শান্ত ড্রেসিংরুমের কথা। ড্রেসিংরুম অশান্ত থাকলে মাঠের পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের দিকে তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। হয়তো আগামী দিনে উদাহরণ হিসেবে আসবে বাংলাদেশের নাম। মাঠের খেলায় যাই হোক না কেন, কথার খেলায় কেউ কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনীও ছাড়তে চাই না এটাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের বাস্তবতা।

নাজমুল হক তপন ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক