‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।... আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।’

উপরের কথাগুলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বলেছিলেন। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আদর্শের কথা বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের এই অধিবেশনে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। এর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি…।’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের এই ধারাবাহিকতাতেই পরবর্তীতে প্রণীত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধান। এই সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, তেমনিভাবে সুস্পষ্ট হয়েছিল মানুষের অধিকার আর মুক্তির প্রশ্নে নবগঠিত বাংলাদেশের প্রত্যয়।

বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ১৯৭২-৭৫ সালে। কিন্তু যুদ্ধোত্তর একটি দেশে এই প্রক্রিয়া এতোটা সহজ ছিল না। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা ভাবতেই পারবো না, প্রায় বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দায়িত্ব গ্রহণকালে সরকারকে কতোখানি বাধার সম্মুখীন হতে হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বলাই বাহুল্য, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ এই দুই স্বৈরশাসক বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথ থেকে ছিটকে ফেলে। সংবিধানের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়া হয় মধ্যযুগীয় বর্বরতার সময়ে।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি খুব স্পষ্ট। ৫০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীরাও ক্ষমতায় ছিল দীর্ঘ সময়। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মগজের ভেতরে ভুল ও বিভ্রান্তমূলক ইতিহাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। রাজনীতিকে কৌশলে সংস্কৃতি বিযুক্ত করেছে এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে কোণঠাসা করেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে তারা বাংলাদেশে নির্মম নিপীড়ন চালিয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কি এই অভিযোগ থেকে মুক্ত? আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে যে আওয়ামী লীগকে আমরা দেখতে পাই, তার মাঝে কি জাতির পিতার ভাবাদর্শ বিরাজমান? বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে; কিন্তু আজকের বাংলাদেশের দিকে যদি তাকাই, প্রশ্ন জাগে কোথায় সেই আদর্শ? গত এক দশকে বাংলাদেশে যেভাবে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ঘটেছে, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে ঘরছাড়া হয়েছেন মানুষ, তার দায় তো আওয়ামী লীগের ওপরও বর্তায়। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারাই তো আছেন।

তৃণমূলে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। 

১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যখন দেশ পরিচালনা করেছিলেন, তখন বাংলাদেশে একটিও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেনি। উস্কানি ছিল, ষড়যন্ত্র ছিল কিন্তু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেনি। আজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললে দেখা যায়, স্বয়ং আওয়ামী লীগের নেতারাই বিভিন্ন রকমের সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছে।

ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক স্থানীয় নেতারা মৌলবাদী উগ্রপন্থীদের পক্ষে সাফাই গাইছে। তাহলে এই আদর্শ বিচ্যুত আওয়ামী লীগ কতখানি বাস্তবায়ন করতে পারবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন? কেবল প্রধানমন্ত্রী একা তো আর এই মহাকর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারবেন না, সেটা সম্ভবও নয়; কিন্তু দল হিসেবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির প্রতি আওয়ামী লীগের যে আপোষ-আচরণ নানা স্থানে প্রকাশ পাচ্ছে, তা দিনশেষে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে?

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল গৃহীত হওয়ার দিন স্পিকার জনাব মুহম্মদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হল, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব Provision করা হয়েছে, যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ Protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে ওই শোষকরা যাতে Protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে।’

এই যে বঙ্গবন্ধু ‘শোষিতের গণতন্ত্রের’ কথা বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের পর কোনো সরকার এই ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে? প্রতিটি সরকারের সময়েই আমরা দেখেছি কালো টাকার দুর্নীতিবাজদের স্বার্থ হাসিল হয়। রাজনীতিকে ব্যবহার করে তারা লুটপাট চালায়। জনগণের সম্পদ চুরি করে তারা বিদেশে বিলাসবহুল জীবন সাজায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, এই দেশ হবে সাধারণ মানুষের। তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই যে চূড়ান্ত উন্নয়ন নয়, এই সত্য তো আমরা বর্তমানে টের পাচ্ছি।

আমাদের অর্থনৈতিক সূচক বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, খাদ্য ঘাটতি কমেছে, অনুন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছি। কিন্তু আমাদের মনন আর বোধের উন্নতি হয়েছে কি?

যেভাবে আমরা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন দেখছি, বাউল শিল্পীদের ওপর ধর্মবাদী গোষ্ঠীর বর্বর নিপীড়নের চিত্র দেখছি, তা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, কেবল অর্থনৈতিক উন্নতি দিয়েই একটি জাতি তার মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক মুক্তি। সেই সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন। এ কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংস্কৃতিকর্মীদের অনন্য অবদান রচিত হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশেও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা। ‘পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল’- এর স্থলে নির্মাণ করেছিলেন শিল্পকলা একাডেমি। পাশ্বর্বতী দেশ ভারত থেকে বৃত্তি এনে এদেশের তরুণদের তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন শিল্প-সংস্কৃতিতে উচ্চতর শিক্ষা।

আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আমাদের আবারও তলিয়ে দেখতে হবে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের খেরোখাতাটি। কীভাবে তিনি মুক্তিসংগ্রামের ইশতেহার রচনা করেছিলেন, কীভাবে একাত্ম হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে, কীভাবে তিনি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ভাষ্য।

আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সেই অসাম্প্রদায়িক দর্শন থেকে যোজন যোজন দূরে। ৫০ বছরের বাংলাদেশকে যদি তার নিজস্ব ইতিহাসের অক্ষরেখায় ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী