ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভালো বন্ধু থাকায় দুর্গাপূজা সবসময়ই একটা দারুণ আনন্দের উপলক্ষ ছিল আমার জন্য। সম্ভবত আমার মতো অনেকের জন্যই। প্রতিবছরের মতো এইবারও শুরু হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে বাজার। ঘুরে অর্থনীতির চাকা।

পূজার সামগ্রিক অর্থনীতির বিস্তর বিশ্লেষণ করলে একজন নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমার বেশ কয়েকটি অনুধাবন রয়েছে। প্রথমত, হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল উৎসবের কেনাকাটায় বিক্রি বাড়ে মার্কেটে, অনলাইনে।

উই-এর উদ্যোক্তারা পুরোদমে পূজার ক্রেতাদের সেরা পণ্যটি দ্রুত পৌঁছাতে ব্যস্ত। বিশ্বজুড়ে মন্দা অর্থনীতির প্রভাব পূজাতে পড়েছে কিছু, তবে আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় অংশ কেনাকাটায় জমিয়ে তুলেছেন এবারের পূজাকে।

প্রতিমার সাজসজ্জা থেকে শুরু করে মুকুট, শাড়ি, অলংকার, লেস, সিঁদুর, ফুলের মালা, প্রতীকী অস্ত্র এসব উপকরণ কিনতে অনেকে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ঢাকার শাঁখারীবাজারে। পূজার জন্য প্রায় ১০০ উপকরণের প্রয়োজন হয়। শাঁখারীবাজার থেকেই এসব উপকরণ সংগ্রহ করা যায়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শাঁখারীবাজার থেকে এসব উপকরণ সংগ্রহ করেন। এছাড়া আমার পরিচিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকে তাদের পুরো পরিবারসহ ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট ও অনলাইন থেকে কেনাকাটা করেছেন।

দুর্গাপূজা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। তাই, এর আয়োজনও বেশ ব্যাপক। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা স্বামীর মঙ্গলের জন্য প্রথা অনুসারে সারা বছর শাঁখা পরেন। তবে সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবে নতুনত্ব চায় সবাই। সোনা বাঁধানো ও ময়ূরের কারুকার্যখচিত চিকন শাঁখা বেশি চলছে কয়েক বছর ধরে। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের শাঁখা আমদানি করা হয়।

পূজার অর্থনীতির দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে—ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মূলত ঈদ-পূজাকে কেন্দ্র করে নতুন পণ্য তোলে, সেই হিসেবে সারাবছরে ব্যবসার বড় সময় এটি। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়টিতে তাদের পণ্য সঠিকভাবে পৌঁছানোটা খুবই জরুরি, তাই কুরিয়ার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা খুব দরকার হয়।

সামাজিক বা ধর্মীয় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। কেনাকাটা ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি গতি পায়। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে ওঠে। উৎসবের কেনাকাটায় অর্থনীতি হয় মুখরিত।

দুর্গাপূজা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। তাই, এর আয়োজনও বেশ ব্যাপক। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানা ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ। সেই উদ্যোগের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে সমাজের বৃহত্তর সম্প্রদায়ও। পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের মানুষজনের বাড়তি কেনাকাটা অর্থনীতিতে বাড়তি গতি সঞ্চার করে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বী সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীদের পূজার উৎসব ভাতায়ও বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা ও ভ্রমণে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বিভিন্ন পেশার লোকবল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ফলে, দুর্গাপূজা শুধু উৎসবের দিক থেকেই সর্বজনীনতা লাভ করে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও সর্বজনীনতা লাভ করে।

দুর্গাপূজা শুধু উৎসবের দিক থেকেই সর্বজনীনতা লাভ করে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও সর্বজনীনতা লাভ করে....

বৈশ্বিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমরা আশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। তবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিবাচক প্রভাব ২০২৩ সালের দুর্গাপূজায় প্রতিফলিত হয়নি।

পার্শ্ববর্তী দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে একটা অংশ সবসময় কেনাকাটাতে ঐ দেশকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এটা যে শুধু পূজার সময় হয় তা নয়, ঈদের সময়ও একই ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তা এবং ই-কমার্সগুলো এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং অনলাইন মার্কেটগুলো বিভিন্ন চমকপ্রদ অফার দিয়েও ক্রেতা পাচ্ছেন না। অল্প পুঁজির উদ্যোক্তারা উৎসবকে কেন্দ্র করে অর্থলগ্নি করেন। কিন্তু আশানুরূপ মুনাফা না পাওয়ায় তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। ধর্মীয় প্রধান উৎসবের এই সময়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

৫ দিনের পূজার অর্থনীতি বিশাল। সেই বিশাল অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল হবে যদি স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে, কোনো ধরনের অসংগতি বা দুর্ঘটনা না ঘটে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ৫ দিনের পূজায় সবমিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ লেনদেন হয়। এই অর্থনীতি হাজার কোটি হবে যখন সার্বিক পরিস্থতি আরও ইতিবাচক হবে। সেই ইতিবাচক দিনের অপেক্ষায় আমরা সবাই।

নাসিমা আক্তার নিশা ।। প্রেসিডেন্ট, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)
nishabd2012@gmail.com